শুক্রবার, ১১ নভেম্বর, ২০১১

এক বাক্যের গল্প

গল্প:০১>
একদিন নদী থেকে আঁজলা ভরে জল নেয়ার সময় আঙুলের ফাঁক দিয়ে সব জল পড়ে যেতে দেখে ঠাকুরদা শঙ্কিত হয়ে বলেছিলেন, 'তোর আঙুলের ফাঁক দিয়েতো তুই তোর ভবিষ্যত ফেলে দিবিরে!' তারও বহুদিন পর মনে হলো সত্যি সত্যিই বুঝি আঙুলের ফাঁক দিয়ে আমি আমার সব কিছু ফেলে এসেছি
গল্প:০২>
সারাজীবন নয়টা-ছয়টা অফিস করে আধপেটা খেয়ে একটাকা দুইটাকা করে জমিয়ে এবং শেষ বয়সে পেনসনের টাকাটা পেয়ে তিনি যখন বাড়ি করছিলেন তখন বাড়ির ডিজাইন, ইঞ্জিনিয়ার, শ্রমিক, ইটকাঠপাথর, এলাকার ছেলেপেলে ইত্যাদির ধকল সইতে না পেরে বুক চেপে মরে গেলে মসজিদের মাইক থেকে তার মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা হলে ঘোষকের সাথে সাথে আমরাও ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্নাইলাহে রাজিওন বললাম
গল্প:০৩>
কালো মেয়েটি ফেয়ার এন্ড লাভলি মেখে মেখেও ছেলেটির উদাসীনতায় নিজেকে ব্যর্থ ভেবে 420 আব্দুল করিমের সাথে চলে গেলে, উদাসীন ছেলেটি মেয়েটির কালো অথচ মিষ্টি মুখশ্রীর কথা স্মরণ করে ভাবে- উড্ডীনকালে আলোর বিপরীতে সকল পাখিই কালো দেখায় আর মানুষ মূলত কথিত স্রষ্টার ন্যায় প্রশংসা পছন্দ করে
গল্প:০৪>
সামান্য সরকারী চাকুরে বাবার শুধু বেতনের টাকায় শহরের সংসার খরচ চালিয়ে গ্রামের দাদা-দাদীকেও কিছু টাকা পাঠিয়ে মাস শেষে যখন শূন্য হাত তখন অবিবেচক আমার একটা ফুটবলের আবদার তাঁকে বিব্রত করে এবং তিনি তা কিনে দিতে অস্বীকৃতি জানালে সারা বিকাল কেঁদে টেদে হতাশার ঘুম শেষে জেগে পাশে একটা শাদাকালো ফুটবল আবিষ্কার করে আনন্দে আটখানা হয়ে দেখি সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে
গল্প:০৫>
বালকটি মসজিদের ইমাম হুজুরের কাছে কুরআন পাঠ শিখতে গেলে ইমাম হুযুর তার ছোট ভাইয়ের কথা স্মরণ করে কাঁদে আর কুরআন ছুঁয়ে ছেলেটিকে শপথ করায় যে হুযুর যা বলবে বা করবে তা অন্য কাউকে কোনদিন কোনসময় কোনভাবেই বলা যাবে না এবং ছেলেটি সরল মনেই এই শপথ করে তারপর হুযুর তাকে আড়ালে অন্ধকারে ডেকে নিয়ে যায় এবং অন্ধকারে রক্তাক্ত হয়ে ছেলেটি নরপশুর কুৎসিত রূপ যখন আবিষ্কার করে তখন সেই কথিত পবিত্র গ্রন্থের কোন পৃষ্ঠায় সেই রক্তের দাগ লেগে থাকে কিনা জানতে চায়লে পীরে আওলিয়া হুজুরে কেরামত দরবারে চিশতী মাওলানা আবদুল বাসেদ ইসলামপুরী প্রথমে বিভ্রান্ত হন অতঃপর গলা খাকড়ি দিয়ে “সব আল্লাহু রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছা, তিনিই পবিত্র রাখেন সকল অপবিত্রতা থেকে” বললে মাজহারুল ইসলাম মুন্না মনে মনে বলে ওঠে ‘হারামজাদা’
গল্প:০৬>
বাইগনবাড়ি স্টেশনে মাঝরাতে ট্রেন থেকে নেমে বাড়ি ফেরার জন্য কোন রিকশা বা ভ্যান না পেয়ে অমাবশ্যার অন্ধকারে একা একা হেঁটেই রওয়ানা হলে একটি কুকুর তার সঙ্গী হয় কিন্তু মনতলা বাজার পেরুতেই কুকুরটি নিরুদ্দেশ হলে তার সদ্যমৃতা স্ত্রীর কথা স্মরণ হয় এবং বাকীটা পথ একাই চলতে হবে ভেবে বুকের ভেতর একটা শূন্যতা অনুভব করতে থাকেন
গল্প:০৭>
ঢাকা ফেরৎ শেফালি তার গর্ভের সন্তানের জনক 'সাইদুলমিয়া' দাবী করলে সাইদুলমিয়া তা অস্বীকার করে কিন্তু সমাজের গণ্যমান্য জঘন্য ব্যক্তিবর্গ সালিশে তাকে লুচ্চা, লম্পট অভিহিত করে কাজী ডেকে শেফালির সাথে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়ার পর বাসর রাতেই সাইদুলমিয়া বাড়ির পাশের কামরাঙা গাছের ডালে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে কারণ সে কাউকেই বুঝাতে পারেনি কেবল চুম্বনে গর্ভসঞ্চার হয় না
গল্প:০৮>
জ্ঞানের ঘাটে রাতের অন্ধকারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে নীরবে করিমন বিবি কাঁদতে থাকার সময় হঠাৎ শহর আলি তার পাশে এসে দাঁড়ালে শহর আলির শরীরের ঘ্রাণ তাকে মোহিত করে এবং শহর আলি তাকে বুকে টেনে নিলে সালমার লাল জুতা আর রঙিন শাড়ির মতো তারও লাল জুতা আর রঙিন শাড়ি না থাকার ব্যথা ভুলে যায়
 গল্প:০৯>
উঠোনে ধরানো আগুন থেকে পোড়া মিষ্টি আলুর খোসা ছাড়িয়ে একটুকরো ভেঙ্গে মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে ভাবে- 'গত বছরের তুলনায় এবার শীত কি বেশি পড়লো, নাকি 'সে' চলে যাওয়ায় শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে!' যদিও প্রতিটি শীত চলে গেলে আমরা পরিযায়ী পাখির কথা ভুলে যাই
গল্প:১০>
সে তার অবসন্ন দেহটি ছড়িয়ে দেয় মেঠোঘরের শীতল বিছানায় তখন নৃত্যরত জোছনা চালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে জন্ম দেয় শাদা ও নরোম দ্বিতীয় মানুষটির তারপর সে আঙুলে জড়ায় স্পর্শ আর কোথাও একতালে গাঢ়ো অথচ ধীর লয়ে বেজে ওঠে স্প্যানিশ গিটার
গল্প:১১>
স্কুলে দেরী করে আসায় প্রথম বেঞ্চে স্থান না পেয়ে প্রতিদিন শেষের বেঞ্চে বসা আমার পাশে প্রথম সে বসে এবং স্কুল শেষে আমাকে বন্ধু ডেকে তার বাসায় নিয়ে গিয়ে তার অনেক খেলনা দিয়ে দু'জনে দীর্ঘ সময় খেলি কিন্তু ফেরার সময় তার একটা খেলনা পাওয়া যাচ্ছে না বলে আমার ব্যাগ সার্চ করে সেখানে কোন খেলনা না পেয়ে বলে – ‘সরি , দোস্ত’ আর আমি কোনদিন কাউকে বন্ধু ভাবতে পারি না
গল্প:১২>
দূরে কোথাও নিশিপাখি কর্কশ কণ্ঠে ডেকে ওঠলে ভয়ে সে আমার ঘনিষ্ট হয়ে শক্ত করে হাত ধরে থেকে ভয় দূর করে অথচ আর একটু পথ হাঁটলেই নির্জন ডুবাটার পাশে আমি তার গলা চেপে ধরবো
গল্প:১৩>
সুপর্ণার বাম স্তনে একটা কালো তিল আছে এই কথা ক্যাম্পাসে রতন ছড়িয়ে দিলে সে কথা সোহানের কানেও যায় আর সোহান যখন সুপর্ণাকে অবিশ্বাসের চাবুকে আঘাত করে তখন প্রচণ্ড আহত সুপর্ণা ভাবে কোন কুক্ষণে সে তার রুমমেট আবিদাকে জানিয়েছিলো তার একটি গোপন তিলের কথা
গল্প:১৪>
ছোট্ট মেয়েটির গাল টিপে আদর করে "এমন কিউট একটা বেবিকে রেখে তার মা কাজে যায় কী করে, হুমমম? আপনাদের তো অভাব নেই, ভাবীর চাকরি করতে হয় কেন বুঝি না" এই কথা বলে সে মেয়েটির বাবার মন ও মনোযোগ আকর্ষণ করে আর অচিরেই আমরা একটা খেলা জমে উঠতে দেখবো কেননা শী ইজ অ্যা গেইমার
গল্প: ১৫>
এ এক আজব ব্যাপার ঘটে যায় দুপুরে যখন সে একচোখাবৃদ্ধের দেয়া হলুদ মাল্টা ফল কেটে স্বামীর পরিবর্তে গোপন বন্ধুকে দেয় তখন সে দেখে মাল্টা থেকে লাল ডালিমের রস বেরোয় আর তার নিজের উরুসন্ধি বেয়ে নেমে আসে চাক চাক রক্ত এবং স্বামীটাও হয়তো তখন পান করছিলো লাল ডালিমের রস কিংবা বেকুবটা তখন হলুদ আলোর বদ্ধঘরে বসে হিসাব কষছিলো অথবা মাইলের পর মাইল সূর্যতাপে দগ্ধ হয়ে শূন্য মাঠে ঘেমে ঘেমে হাঁটছিলো
গল্প: ১৬>
বৃদ্ধ রিকশাওয়ালাটিকে জোয়ান রিকশাওয়ালাটি দ্রুতগতিতে অতিক্রম করে গেলে বৃদ্ধটি “অই পইড়া গেছে!” মিথ্যা বলে, ফলে তরুণ রিকশাওয়ালাটি গতি কমিয়ে থামে আর বৃদ্ধটি তাকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে গিয়ে মিট মিট হাসে এবং অনতিবিলম্বে তরুণ রিকশাওয়ালাটি পুনরায় দ্রুতগতিতে বৃদ্ধকে অতিক্রম করতে চাইলে প্রথমে সাইড দেয় কিন্তু পরক্ষণেই রাস্তার মাঝখানে চলে আসে তখন তরুণ রিকশাওয়ালাটি রিকশার গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে র্দুঘটনার শিকার হলে বৃদ্ধটি চোয়াল শক্ত করে চাবিয়ে চাবিয়ে বলে, ‘শালার জৈবন’
গল্প: ১৭>
এ্যাকুরিয়ামের মাছগুলো কথা বলা শিখে গেলে আমরা একটি একটি করে তাদের সবকটিকে মেরে ফেলে নিঃশ্চিন্ত হলাম
গল্প: ১৮>
চতুর্থবারের মতো আত্মহননে ব্যর্থ হলে সে আমার পিঠে হাত রেখে গাঢ়ো কণ্ঠে বলে, 'চুপচাপ বেঁচে থাকাই আত্মহত্যার সহজ উপায়' তখন আকাশে একটা চিল সূর্যের চারপাশে উড়ছিলো কিনা মনে নেই
গল্প: ১৯>
খরায় সকল জলাশয় শুকিয়ে সব মাছ মরে গেলে গভীর জলাশয়টির শেষ জলটুকুতে একটি পুঁটি মাছ তখন জীবিত ছিলো, তার পাশেই বাঁশের খুঁটিটিতে ক্ষুধার্ত মলিন কাতর মাছরাঙা বন্ধুটিকে বসে থাকতে দেখে- "বন্ধু, আজ দুপুর পর্যন্ত রোদ গড়ালে এই জলাশয়ের শেষ জলবিন্দুটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আর তখন আমার মৃত্যু নিশ্চিত; এর চেয়ে তুমি আমাকে খেয়ে ফেল, তুমি অন্তত একদিন বেশি বাঁচবে" এই কথা বলে এবং যখন দুপুর গড়িয়ে গেল আর মাছরাঙা চোখে জল নিয়ে প্রিয় বন্ধু পুঁটি মাছটিকে খেতে শুরু করলো তখন পুঁটি মাছটি মরে যেতে যেতে তার নিজের রক্তে মাছরাঙার বুকটি লাল করে দিয়ে গেল
গল্প: ২০>
শঙ্খমিত্রার ম্যালা জল শুকিয়ে গেলো এবং অনেক নৌকার পালও বদল হলো এই ত্রিশ বছরে তবুও ফুলবানুর খোঁজ আর না পেয়ে সকলেই তাকে প্রায় ভুলে যায় আর আক্কেল মিয়াও তার শালিকা পরীবানুকে বিয়ে করে ত্রিশ বছরের সংসার যাপন করে কিন্তু মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে আক্কেল মিয়া যখন অবচেতন মনে ডুকরে কেঁদে বলে, ‘ও ফুলবানু, তুই আমারে ক্ষমা করিস ফুলবানু’ তখন পরীবানু ভাবে তার বোনের প্রতি আক্কেল মিয়ার প্রেম বুঝি চাগার দিয়ে ওঠে কিন্তু কারো কারো মনে এই প্রশ্ন উঁকি দিয়ে ওঠে যে, ক্যান আক্কেল মিয়া মরার সময় ফুলবানুর কাছে ক্ষমা চায়?
শেষ গল্প>
কিশোরী মেয়েটি তার টিউটরের প্রেমে পড়ে গেলে মা তা বুঝতে পারে এবং এক সন্ধ্যায় মা টিউটরের হাত ধরে বসে থাকে তারপর মেয়েটিকে বলে, তোমার টিউটরের মতো অসভ্য আমি দেখিনি, সে আমার হাত ধরতে চায়, আমি ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলিনি, শুধু বেতন দিয়ে বলেছি আর যেন এ বাসায় না আসে