শনিবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

অন্ধ চড়াই পাখির ডানার উষ্ণ ঘ্রাণ


চাঘরের চায়ের দাগে ভরা কালচে টেবিলটিতে দুই হাতের কুনুই রেখে তালু দিয়ে ঘষে ঘষে দূর করছিলাম নাক-মুখের ক্লান্তি। কম্পিউটার অপারেটরদের কম্পিউটারের মনিটরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা ক্লান্তিকরই বটে। পাশেই বসে ছিলো মোটা চশমা চোখে শাদাদাড়িগোঁফের এক বৃদ্ধ আর তার পাশে ছয়-সাত বছরের একটি বালকশিশু। বৃদ্ধটি চু চু শব্দ করে নিজের ভেতরে ঢেলে নিচ্ছিলেন গাভীর দুধে তৈরি গরম চা। আর শিশুটি একটি বড় টোস্ট বিস্কুট চায়ের কাপে ডুবিয়ে ডুবিয়ে খাচ্ছিলো। শিশুটি যখন বৃদ্ধজনকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা দাদা, অন্ধ চড়াই পাখির বাচ্চার ডানায় কেন উষ্ণ ঘ্রাণ থাকে? তখনই আমি তাদের লক্ষ্য করি। শিশুটির মুখ দেখি। দাঁতপড়া খালি মাড়ির বৃদ্ধটির হা হা করে হাসি শুনি। আর আমার মনে পড়ে যায় আমিনুলের কথা।

বাবার চাকরি তখন ঈশ্বরগঞ্জে। নতুন স্কুলে ভর্তি হয়ে তৃতীয় শ্রেণির ক্লাসে গিয়ে বসার জায়গা পেলাম সবার শেষের বেঞ্চে। ঐ বেঞ্চে আগেই বসে থাকা ছেলেটি জানালা দিয়ে ওপাশে পুকুরে একদল হাঁসের মাছ খাওয়ার দৃশ্য দেখছিল একদৃষ্টে, আমার দিকে তাকালো না। প্রথমে এক স্যার এসে রোল ডেকে ক্লাস শুরু করলেন, বাংলা।  আমি যে নতুন এসেছি, আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন নি। ক্লাসের কেউ আমার প্রতি আগ্রহও দেখায় নি। দ্বিতীয় ক্লাস গণিত। স্যার আসার আগে থেকেই সবাই শান্ত হয়ে বসে থাকলো। পিনপতন নিরবতা। ক্লাসে ঢুকলেন কুচকুচে কালো এক স্যার, পড়নে ধবধবে শাদা পাজামা পাঞ্জাবি। হাতে সরু বেত। এসেই বেত দিয়ে টেবিলে দুইটা বাড়ি দিয়ে শব্দ করে বললেন বাড়ির কাজের খাতা বের করার জন্য। ছেলেরা বাড়ির কাজের খাতা বের করে নিজ নিজ বেঞ্চে রাখলে তিনি হেঁটে হেঁটে সবার খাতা চেক করছিলেন। যারা আনেনি তাদের আচ্ছামতো বেত দিয়ে পেটাচ্ছিলেন। যারা বাড়িরকাজ এনেছে তারা মিটমিট করে নীরব হাসি হাসছিলো মারের দৃশ্য দেখে। আমার পাশের ছেলেটি বাড়ির কাজ আনে নি। তাই সেও মার খেলো। আমারও বাড়ির কাজ নেই, আমি ক্লাসে নতুন। এই কথা স্যারকে বলা প্রয়োজন। কিন্তু স্যারের ভয়ানক মূর্তি দেখে কোন কথাই মুখ থেকে বের হচ্ছিলো না। স্যার বেত উঠালেন আমাকে মারার জন্য। তখন পাশের ছেলেটি তার মার খাওয়া পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে স্যারকে জানালো, 'স্যার, হে নতুন আইছে'। ফলে আমি সম্ভাব্য মারের হাত থেকে বেঁচে যাই। স্যারের বেত নেমে গেলো। ক্লাসের সবাই আমার দিকে তাকালো। স্যার বিমর্ষ মুখে চিকন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন- তোর নাম কি?

আমার বাসা ছিলো স্কুলের পাশেই কাঁচামাটিয়া নদীর তীরে। টিফিনে বাসায় এসে খেয়ে পুনরায় স্কুলে গিয়ে ছেলেটির পাশে গিয়ে বসলে, এই প্রথম ছেলেটি আমার কাছে জানতে চায়, অন্ধ চড়াই পাখির ছানার গাঁয়ে উষ্ণ ঘ্রাণ থাকে কিনা। আমি প্রথমে বুঝতে পারি না তার কথা। তারপর সে জানায় তাদের বাড়িতে একটা চড়াই পাখির বাসা আছে, সেখানে দুটি বাচ্চা চড়াই আছে। তাদের মা গতরাতে বাসায় ফিরে নি। গত রাত থেকে বাচ্চা দুটি টুই টুই করে কেঁদেছে। আজ সকালে সে চড়াইয়ের বাচ্চাদুটিকে ভাত খেতে দিয়েছিলো, খায় নি। কিন্তু বাচ্চাদুটির গা থেকে কেমন এক গরম গরম ঘ্রাণ সে পায়। এরপর সে জানালা দিয়ে পুকুরের পাড়ে এক কঞ্চিতে বসা একটা মাছরাঙ্গার দিকে তাকিয়ে থাকে, কথা বলে না আর। তার নাম জানতে চায়লে সে উত্তর দেয় না। ক্লাস শুরু হয়ে যায়। ক্লাস শেষ হয়। আবার ক্লাস শুরু হয়। আবার শেষ হয়। এবং এক সময় ছুটির ঘন্টা বাজে। বাসায় ফেরার সময় পেছন দিক থেকে সে আমার নাম ধরে ডাকে। আর বলে, 'আমি নুল'। তারপর চলে যায়। আমি প্রথমে ভাবি- নুল কী জিনিস! পরে বুঝতে পারি তার নাম আমিনুল।
আমিনুল ক্লাসের সব চেয়ে অমনোযোগী। কোন ক্লাসেই সে ভালো ভাবে পড়া বলতে পারে না। আর কারো পিঠে পড়ুক বা না পড়ুক গণিত স্যারের বেত তার পিঠে পড়বেই। কেউ তার সাথে খুব একটা কথাবার্তা বলে না, সেও কারো সাথে যায় না। যেহেতু প্রথম দিন সে আমাকে গণিত স্যারের নির্ঘাত মারের হাত থেকে বাঁচিয়েছে তাই তার প্রতি আমার একটা মায়া জন্ম নেয়। প্রথম দিন আমাকে মারের হাত থেকে বাঁচানোর কৃতজ্ঞতা থেকেই বোধ হয় মনে মনে তাকে বন্ধু করে নিয়েছিলাম। বাবা এক সকালে পাড়ার মসজিদে নিয়ে গেলেন হুজুরের কাছে কুরআন শেখার জন্য। গিয়ে দেখি সেখানেও আমিনুল। আমিনুল ও অন্য ছেলেমেয়েরা সিফারায় আর আমি কায়দা দিয়ে কুরআন পাঠ শিখতে থাকলাম।

একদিন টিফিনের সময় বাসায় এসে খেয়ে-দেয়ে বের হয়ে দেখি আমিনুল আমাদের বাসার সামনে নদীর তীরে কী যেন করছে। কাছে গিয়ে দেখি একটা বাঁশের কঞ্চি সে মাটিতে গিঁথে রাখছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে সে প্রতিদিন নদীর পানি কতোটুকু বাড়ছে তা মেপে রাখছে। মাটিতে গাঁথা কঞ্চিটি দেখিয়ে বললো, 'কাইল দেইখো এইটা ডুইবা যাইবো'। তখন বর্ষাকাল। নদীর পানি বাড়ছিলো।আমরা প্রতিদিন খুঁটি গেঁড়ে পানি মেপে আসতাম। এক বৃহস্পতিবার দুপুরে স্কুল ছুটি হয়ে গেলে নদীর পানি মাপার পর মা বললেন আমিনুল যেন খেয়ে যায়। তো তাকে নিয়ে খেতে বসলাম। মা ডিম ভুনা আর শিং মাছের তরকারি দিয়ে খেতে দিলেন। তাকে আস্ত একটা ডিম খেতে দেয়া হলে ইতস্তত করে সে খেলো।
খাওয়ার পর নদীর তীরে আমরা যখন এসে দাঁড়ালাম তখন সে আমাকে জানালো জীবনের প্রথম সে আস্ত একটা ডিম খেয়েছে। এবং আমাকে বললো সে তার নানা বাড়ি থেকে একটা রাজহাঁসের বাচ্চা এনেছে। রাজহাঁসটা বড় হয়ে যখন ডিম দেবে তখন একদিন তাদের বাড়িতে রাজহাঁসের আস্ত একটা ডিম দিয়ে দাওয়াত খাওয়াবে । হাত দিয়ে সে রাজহাঁসের ডিমের আকারটাও দেখালো।
দু'জনে অনেকক্ষণ ঘুরলাম। সে আমাকে সোনালি টকিজ নামের সিনেমা হলের এক লোকের কাছ থেকে বিক্রিত টিকেটের মুড়ি দিয়ে বললো- এইটা দিয়া টাকার বান্ডেল বানায়া খেইলো। পাটবাজার, দুধমল, ব্রীজ ঘুরে বাড়ি ফেরার সময় সে বললো কেউ যদি কুরআন ছুঁয়ে শপথ করতে বলে তবে আমি যেন সেটা জীবনেও না করি।

একদিন মসজিদে কুরআন শেখার পাঠ শেষে চলে আসার সময় হুজুর আমাকে ডেকে নদীর কাছে নিয়ে গেলেন। জানতে চায়লেন আমি প্রতিদিন কেন সিনেমা হলের পোস্টার দেখতে যাই। আমি অবাক হলাম। ভয়ও। হুজুর হয়তো বকবেন ভেবে। আমি জানতে চাইলাম তিনি আমাকে কি করে দেখলেন, আমিতো তাঁকে দেখি নাই। হুজুর হেসে জানালেন কুরআনে একটা সুরা আছে, যা শুদ্ধভাবে তিনবার পাঠ করে অদৃশ্য হতে চায়লে অদৃশ্য হওয়া যায়। আমি বিস্মিত হলে আর কাউকে না জানিয়ে বিকেলে আছরের নামাজের পর তার ঘরে গেলে তিনি আমাকে কীভাবে অদৃশ্য হওয়া যায় দেখিয়ে দেবেন বলে জানালেন। আমি বিকেলে তার কাছে যাবো কথা দিলাম এবং এও কসম করলাম বিষয়টা কাউকে জানাবো না। কিন্তু স্কুলে এসে কথাটা আমিনুলকে না জানানো পর্যন্ত কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। তাই টিফিনের সময় আমিনুলকে হুজুরের কথাটা বলেই দিলাম। আমিনুল খুব দুঃশ্চিন্তা গ্রস্ত হয়ে পড়লো বলে মনে হলো। সে আমাকে খুব করে মানা করলো আমি যেন হুজুরের ওখানে কিছুতেই না যাই। স্কুল ছুটির সময় সে আমার পেছন পেছন পুকুর পাড়ে এসে বললো, 'হুজুরের কাছে যাইও না কিন্তু‍!' তারপর চলে গেলো। আমি বাসায় এসে হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় শুয়ে আছরের অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে জেগে দেখি মাগরিবের আযান পড়ে গেছে। 
পরদিন সকালে মা মানা করলেন হুজুরের কাছে কুরআন শিখতে যেতে হবে না। কিন্তু আমার যাওয়া জরুরী ছিলো, হুজুর হয়তো রাগ করেছেন! শেষে মা রেগে জানালেন, হুজুরকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। স্কুলে গিয়ে জানতে পারলাম আছরের পর হুজুর আমিনুলকে নির্যাতন করেছে। আমিনুল চিৎকার শুরু করলে আশেপাশের লোক এসে তাকে রক্ষা করে আর হুজুরকে মার দিয়ে পুলিশে দেয়।

আমিনুল সুস্থ হয়ে স্কুলে আসা শুরু করে। কিন্তু ক্লাসের ছেলেরা তাকে 'অসতী' বলে ক্ষেপানোর চেষ্টা করতো। কিন্তু আমিনুল শুধু আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো, আর কিছু বলতো না। আমিও বিব্রত বোধ করে তার পাশে বসা ছেড়ে দিলাম। এরপর একদিন আমিনুল স্কুলে আসা বন্ধ করে দিলো। আমি আর তাকে খুঁজে পাই নাই। 

শুক্রবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

আত্মহত্যা

অন্ধকার গলিটাতে ঢুকতেই আধো আলোয় চোখে পড়লো লোক দুটিকে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। আমি ভয়গ্রস্তের মতো প্যান্টের ডান পকেটটা ডান হাতে চেপে ধরে দ্রুত তাদের অতিক্রম করতে চাচ্ছিলাম। একজন বললো- 'এই যে শুনেন!' পথ আগলে দাঁড়ালো। আমি ডান পকেটটা আরো শক্ত করে ধরে জানিয়ে দিলাম আমার কাছে কিছু নেই। দ্বিতীয় জন জানতে চায়লো আমার পকেটে কী। আমি কাতর কণ্ঠে আবেদন জানালাম, 'এই লাখ খানেক টাকাই আমার শেষ সম্বল, প্লিজ নেবেন না।' অন্ধকারে তাদের মুখ স্পষ্ট দেখা যায় না। একজন এসে পেছন থেকে জাবরে ধরলো। সুবিধা করতে পারলো না। অন্যজন হয়তো একটা ছুরি-টুরি বের করেছে। আমি আমার সিনাটা টান টান করে দেখিয়ে বললাম, 'এই খানে প্রাণ থাকতে কেউ আমার পকেটে হাত দিতে পারবে না।' পেছনের জন সমস্ত শক্তি দিয়ে আমাকে টেনে ধরলো আর সামনের জন বুকে বিঁধিয়ে দিলো ছুরিটা।

আমার পকেটে খামের ভেতর টাকার পরিবর্তে চিঠি ও আর আর কাগজ দেখে নিশ্চয়ই মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিলো ছেলে দুটোর।