মঙ্গলবার, ২৮ জুন, ২০১১

ইতিন

বাদর ছেলেটা সকাল থেকে একবারও খাবার দেয়নি। রিচুকে পটকু এক দানা খাবার বের করে দিয়েছে মুখ থেকে। পটকু একটা রাক্ষস আর ধুরন্দর। খাবার দেয়ার সাথে সাথে দানা দানা খাবার মুখের মাঝে পুরে ফেলে। দুএকটা দানা মুখের মাঝে জমিয়ে রাখে। রিচুকে সে খাবার দিয়ে দিয়ে তার বন্ধু বানিয়ে নিয়েছে। রিচুটাও কী হ্যাঙলারে বাবা! পটকু, রিচু এ্যাকুরিয়ামের একপাশে বসে কি যেন পুনুর পুনুর করছে। হ্যাবলা কালোটা ঝিমিয়ে আছে। আমি একা একা খাবারের জন্য বসে আছি। উফ ক্ষুধায় কিচ্ছু ভালো লাগছে না।ইতিন যখন এমনটি ভাবছিলো। তখনই ছেলেটা এ্যাকুরিয়ামের দিকে আসলো। পটকু আর রিচু তখন নিজেদের আলাপে মশগুল। ইতিন ভাবলো ছেলেটা খাবার দিতে এসেছে। সে সাঁতরিয়ে উপরের দিকে উঠে এলো। আর উপরে উঠতেই ছেলেটা দুই হাত দিয়ে খপ করে তাকে ধরে উপরে নিয়ে আসলো। উরে বাবা!বলে ইতিন একটা চিকার করতে পারলো। সে চিকার রিচু শুনলো কি না কে জানে!
তখন খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো। ছেলেটা ইতিনকে ধরে এনে কাদা জলে ছেড়ে দিলো। জল পেয়ে শ্বাস নিলো ইতিন। কিন্তু এই নোংরা জলে তার ঘেন্না করতে লাগলো। সে পুরো বিষয়টায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। সামনে একটুকরা খাবার ছিলো, নোংরা খাবার। সেটাই সে খেয়ে নিলো গপ করে। ছেলেটা তাকে তাড়া করছিলো সাঁতার কাটার জন্য। সে কিছুক্ষণ সাঁতার কাটালো। হঠা একটা কালো মাছের বাচ্চা দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বললো, এই যে, আসো আমার সাথে হুদোল ছুঁচোটা তোমাকে মেরে ফেলবে, পালাও, গিচুং গিচুং। ইতিন এই বিষয়টাও বুঝলো না আর ‌‘গিচুং গিচুংও বুঝলো না।তবু জীবনের মায়ায় কালো মাছের বাচ্চাটার পেছনে সাঁতরাতে লাগলো। কালো মাছের বাচ্চাটা খুব দ্রুত সাঁতরায়। আর সাঁতরাতে সাঁতরাতে গ্যা, গুচ করে বাঁক নেয়। ইতিন কিছুই লক্ষ্য না করে অনেকক্ষণ কালো মাছের বাচ্চার পেছন পেছন সাঁতরিয়ে এলো। একসময় কালো মাছের বাচ্চাটা থেমে গেলো। ইতিনও হাঁফাতে হাঁফাতে থামলো কিংবা থেমে হাঁফাতে লাগলো। তুমি ওই হুদোলটার হাতে পড়লে কি করে?’ চোখ নাচিয়ে কালো মাছের বাচ্চা জানতে চায়। ইতিন কিছু না বলে জানতে চায়, তোমার নাম কি?
কালো মাছের বাচ্চাটা একটা ঘূর্ণি কেটে লেজটাকে দুএকটা মোচড় দিয়ে গলাটাকে গম্ভির করে বলে, ‘আমার নাম রুফি টাকি। তোমার নাম কি?’
ইতিন।
এটা আবার কেমন নামরে বাবা! ভুশশশশ
ইতিন হেসে ফেললো- কেন? নামটা সুন্দর না?
হুমমম, সুন্দর, কিন্তু তোমার গায়ের রঙ এমন হলো কি করে? এতো সোনালি! তোমার মতো এমন গায়ের রঙ আগে কারো দেখিনি।
ও।
ইতিনের হঠা মন খারাপ হলো। রিচু, পটকু আর কালো ভ্যাবলাটার জন্য তার মনটা কেমন করতে থাকলো। আহারে রিচু, পটকু, ভ্যাবলা! তাদের সাথে আর জীবনে দেখা হবে কি না কে জানে!
গ্যাচুং, গ্যাচুং তুমি এতো কি ভাবো? জানতে চায় রুফি।
ইতিন বলে, কিছু না।
চলো আমার সাথেবলেই রুফি চলতে শুরু করে। ইতিন তার পেছন পেছন চলে। এটা একটা নর্দমা। নোংরা পানিতে গা ঘিন ঘিন করছিলো ইতিনের। কিন্তু একটু সময়েই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। বৃষ্টি হওয়ায় পানির খুব স্রোত। স্রোত কেটে কেটে রিফুর পেছনে পেছনে এগিয়ে চলে ইতিন। পথে চলতে চলতে একটা পুঁটি মাছের সাথে দেখা হয়। রিফু তাকে মাথা দিয়ে ঢুঁশ দেয়। ঢুঁশ খেয়ে পুঁটিটা হাসতে হাসতে শেষ। ইতিনকে দেখে বাঁকা চোখে তাকায়। রিফুর কাছে জানতে চায়, এটা কে রে? রিফু বলে, ও ইতিন, আমার বন্ধু। নতুন এসেছে। পুঁটিটা এসে ইতিনের গা শুঁকে। তারপর বলে, বেশ সুন্দর, বেশ সুন্দর। তারপর হেঁড়ে গলায় গান ধরে আমার ভিন দেশী তারা.... । আর হাসতে হাসতে চলে যেতে থাকে। ও খুব ভালোবললো রিফু। ইতিন উদাস কন্ঠে বলে, ‘'কিছু দিন আগে সে তার বাবা-মাকে হারিয়ে ফেলছে। এখন সে একা একা থাকে।'
ইতিনের মনটাও খারাপ হয়ে যায়, তার মনে হয়, সেও তো একা।
কিছুটা পথ যেতেই রিফুর মতো দেখতে তিনটা মাছ এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়। তাদের একটা রিফুকে জিজ্ঞেস করে, ওই রিপ্যুা, তোর লগে এইডা কেডারে?
আমার বন্ধু ইতিন।
ওরা এসে ইতিনের চারপাশে ঘোরপাক খায়। ইতিনের ভালো লাগে না। রিফু বলে, চলো ইতিন।
মাছ তিনটা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। রিফু তাদের সাথে আর কথা বলে না। তারাও রিফুর সাথে কথা না বলে গুম মেরে থাকে।
(
২রা জুন, ২০১১)

ইতিনকে নিয়ে রিফু নর্দমার একটা ফোকরে ঢুকে পড়ে। এসো, এটা আমাদের বাসা।বলে নিয়ে যায় ভেতরে। ইতিন খুব বিব্রত বোধ করে। এ রকম পরিস্থিতির স্বীকার সে জীবনেও হয়নি। ভাবনার অতীত একটা কাণ্ড ঘটে গেলো তার জীবনে। রিফুকে দেখে ছুটে আসে দুইজন, একটি ছেলে আর একটি মেয়ে টাকি মাছ। দুজনই রিফুর চেয়ে বয়সে ছোট। ইতিনকে দেখে তারাও বিস্মিত হয়। রিফু পরিচয় করিয়ে দেয় ইতিনের সাথে তার ছোট ভাই জিফুও বোন সাইফুকে। কোণের অন্ধকার থেকে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে আসেন, ‘রিফু, তুমি কি স্কুল থেকে ফিরলে?... আরে .. এ কে?’ রিফু ইতিনকে তার দাদুর সাথেও পরিচয় করিয়ে দিলো। দাদুকে সব খুলে বললো। দাদুর কপালে চিন্তার রেখা দেখা গেলো। তাহলে বলতে চাচ্ছো, ইতিনের কেউ নেই?’
হ্যাঁ, তাই।বললো রিফু। সে তবে আমাদের এখানেই থাকবে?’ দাদু জানতে চায়লো। রিফু ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। বাবাহীন চার জনের সংসার মা একা টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। এখানে ইতিনের থাকাটা বাড়তি ঝামেলাই। রিফু ইতিনের সামনে লজ্জায় মাথা নত করে রাখলো। ইতিনও বিব্রত অবস্থায় কি বলবে বা কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিলো না। দাদু তখন হা হা করে হেসে বললেন, ইতিন আমাদের এখানেই থাকবে। ইতিন আমাদের পরিবারেরই একজন। জিফু আর সাইফু লাফিয়ে উঠলো আনন্দে। কিন্তু রিফু, ইতিন আর দাদুর ভেতরে ভেতরে ঠিকই একটা অস্বস্তি গুম হয়ে থাকলো। অনেকটা সময় তারা সহজ হতে পারলো না।
আরো কিছুক্ষণ পর রিফুর মা বাসায় ফিরলো। ইতিন একটা কোণে চুপটি করে বসেছিলো। রিফু তার বাড়ির কাজ করছিলো। জিফু আর সাইফু কি যেন খেলছিলো। আর দাদু একটা কাগজে কি যেন আঁকি-বুকি করছিলো। রিফুর মা খুব মোলায়েম কণ্ঠে তার সন্তানদের নাম ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকলেন। প্রথমে ইতিনকে তিনি খেয়াল করেননি। কারণ ইতিন অন্ধকার কোণটায় বসেছিলো। জিফু আর সাইফু দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। তাদের মা তাদের আদর করলেন। রিফু চুপ করে বাড়ির কাজের খাতায় অঙ্ক করছিলো। তাকে চুপ দেখে মা তার দিকে এগিয়ে এলেন। কিরে স্কুলে মার খেয়েছিস? এতো চুপচাপ কেনো?’ তখনই চোখে পড়লো ইতিনকে। বাহ্ কি সুন্দর! কে গো তুমি?’ জিজ্ঞেস করলো ইতিনকে। ইতিন মাথা নিচু করে জবাব দিলো আমি ইতিনভারী মিস্টি নামতোমা এগিয়ে গেলেন ইতিনের দিকে পাখনা দিয়ে আদর করে দিলেন। তখন দাদু তার ভাঙ্গা চশমাটা খুলে মুছতে মুছতে বললেন, বৌমা ইতিনের মতো আমার এক বন্ধু ছিলো বুঝলে, তার নাম ছিলো রৈরাঙ বেলে। ঠিক ইতিনের মতো নয় কিন্তু সোনালি দাগ কাটা। তো বিষয়টা হচ্ছে কি জানো? ....’ দাদু মাকে ইতিনের বিষয়টা সময় নিয়ে গুছিয়ে বললেন। ইতিন ও রাফু এবং দাদু মনে করেছিলো মা রাগ করবেন এবং ইতিনকে এখানে থাকতে দিবেন না। কিন্তু মা কিছুই বললেন না। সব শুনে ইতিনকে কাছে টানলেন, আদর করে দিলেন। বললেন, ‘তুমি আমার আরেকটা ছেলে।ইতিনকে কেউ এভাবে আদর করেনি আগে। কি এক অদ্ভুত কারণে তার চোখ ভেঙ্গে কান্না আসতে লাগলো। রিফু মার কথা শুনে দৌড়ে এসে ইতিনকে জড়িয়ে ধরলো, তা দেখে জিফু আর সাইফুও এসে ইতিনকে জড়িয়ে ধরলো।
রাতে খাওয়া-দাওয়ার সময় ইতিন কিছুই খেতে পারলো না। সে তার সারা শরীরে ব্যথা অনুভব করতে থাকলো। দাদু বললেন আবহাওয়ার পরিবর্তনে ইতিনের এই ধরণের সমস্যা হচ্ছে। ঠিক করা হলো সকালে কাকিলা ডাক্তারকে ডেকে আনা হবে। ইতিন প্রচণ্ড জ্বর কিন্তু অদ্ভুত আনন্দ নিয়ে রিফু, জিফু আর সাইফুর সাথে ঘুমুতে গেলো।
সকালে ঘুম থেকে জেগে কাঁথা গায়ে দিয়ে বসে থাকলো ইতিন। মা ঘরের কাজগুলো সারছিলেন। জিফু আর সাইফু ঘুম ভাঙ্গা অবসন্নতা নিয়ে চুপচাপ বসে ছিলো। দাদু দীর্ঘ সময় ধরে তার দাঁতগুলো পরিষ্কার করে শাদা চুলগুলো আঁচড়ালেন। তখনি রিফু কাকিলা ডাক্তারকে নিয়ে হাজির হলো। ইতিন এ রকম ভয়াবহ আকারের মাছ আগে দেখেনি। সামনে অনেকগুলো দাঁত। তবে বুড়ো হয়ে যাওয়ায় কিছু দাঁত পড়ে গেছে। কথা স্পষ্ট উচ্চারিত হয়না, কিহে, টাক্কু তোমাদের আবার কার অসুখ হলো? দাদুর বন্ধু কাকিলা ডাক্তার। দাদুর টাক নেই। তবু টাকি মাছের জন্য তাকে টাক্কু বলে ডাকেন। দাদু ইতিনকে দেখিয়ে দিলেন আমার নাতি, দেখোতো কি হইলো?’ অনেকক্ষণ তিনি ইতিনকে দেখলেন। জিহ্বা, চোখ, নারী নক্ষত্র। তারপর বললেন, ঠিক হয়ে যাবে। এরপর ইতিনের একটা পাখনায় একটা দাঁতদিয়ে কামড়ে দিলেন। ইতিনের খুব ঘুম পেতে থাকলো। কিন্তু সে ঘুমালো না। ঘুম ঘুম আবেশে থেকে সে শুনতে পেলা ছাড়া ছাড়া কিছু কথা- নদীতে যাওয়ার ম্যাপটা আমার ঠিক আছেহ্যাঁ, তারাইতো আন্দোলন করলো তত্বাবধায়ক সরকারের জন্য।’ ‘সংসদে না গিয়ে চিল্লা-পাল্লা আর হরতাল করে কি লাভ, ওরা বসে সমস্যা সমাধান করুক। এরপর একটা গভীর ঘুমে ইতিন তলিয়ে গেলো।
(
২৯ জুন, ২০১১)

আশা রাখি এই গল্পটা এই পোস্টেই বিবর্ধিত হবে ক্রমে .....

রবিবার, ২৬ জুন, ২০১১

বন্ধু, ওখানে স্পর্শ করো না, ওখানে ক্ষত জমে আছে


একবার দেখো আমি ‘বন্ধু’ শব্দটাকে কতোটা আদর করে জড়িয়ে রেখেছি। ওখানে স্পর্শ করো না, ওখানে ক্ষত জমে আছে। একবার ভাবতো আমি কি ছিন্ন করেছি রোদ? আমি কি লঙ্ঘন করেছি সীমার আঁধার? আমি বরাবর আমার সম্পর্কে সচেতন। বন্ধু, আমাকে ছেড়ে যাওয়া জোনাকিদের আমি চলে যেতে দেই তাদের ভালোবাসি বলে। এই আঁধারটুকু আমার থাক।
দেখো, তোমাকে সাজিয়ে রেখেছি, ওখানে স্পর্শ পড়েনি ভুল। তোমাকে কামড়ে খায়নি ভেতরের প্রেত। আমি পারি, আমাকে এভাবেই গুছিয়ে রেখেছি। আমি ছাড়া কেউ বাজাতে পারবে না আমার এস্রাজ। আমার এস্রাজে আমি ভুল সুর তুলি না।
তোমার কাছে আমার অনেক গানের দেনা। তোমার কাছে আমি সুরের ঋণে বন্দী। তোমার কণ্ঠে আমার অলকধানের ফসল। তোমার চোখে বুনে দিয়েছি কৃষ্ণপ্রহরের ঘুম। আমাকে ক্ষমা করো, বন্ধুত্বের চেয়ে আর বড়ো কোন ঋণ নেই।
তুমিও চাচ্ছিলে, আমিও ছিঁড়ে দিলাম প্রণয় বকুল। আঙুলে জড়াবো না আঙুলের শোক। ভালো থেকো, ভালো থেকো।
“একজন একা একা গুছিয়ে নিচ্ছে মৃত্যু ও মদের দুপুর”
তুমি জানো দুপুরের রোদ অসুখ আমার। তুমি জানো ভেতরে পোষা অসুখে জীর্ণ আমার চোখের পাতা। দ্রাক্ষারসে ধুয়ে দেওয়া তোমার আলিঙ্গন পূর্ণ হলো। দুপুরের রোদে বিহ্বল বাতাসে বাঁশপাতা কাঁপলে ভুলে যেও পথের ধুলোয় আমার পায়ের চিহ্ন জমা। আমি একা থাকি, একাই বাঁচি। আমি আমাকে পাল্টাবো না। তুমি যাতে বিরক্ত না হও তার জন্য একটা দেয়াল টেনে দিয়েছি। এটাকে কান্না ভেবো না। আমি কখনো কখনো প্রচণ্ড নিষ্ঠুর। নিষ্ঠুর সময়ে কেউ কখনো কাঁদেনা।

শনিবার, ২৫ জুন, ২০১১

আঙুলে লিখি আঙুলের ক্ষয়


ভুলে গেছি তার শরীরের ঘ্রাণ – আঙুলের ভাঁজ, বিবর্ণ চর্তুমাত্রিক স্বপ্নের ভেতর ছুটে চলা বিভ্রান্ত পথিক। সামনে দাঁড়িয়ে সব প্রেতের মিছিল। একটা দীর্ঘ ঘুমের প্রত্যাশায় চোখের কোণে রাত্রি টানিয়ে রাখি। আজও আমার মরণ হলো না ভিষণ; তার চোখের তারায় আমার প্রতিবিম্ব নেই – এই সত্য অনুধাবনের পর কেউ কেউ আত্মহত্যার প্ররোচনা দেয় – আমিওতো আমার ভেতর একা একা থাকি- শব্দের প্রতিধ্বনির সূত্র ভুলে তার কানের কাছে শব্দ করে শব্দের প্রতিফলন প্রত্যাশা করি। আমি তাকে একটা চিঠি লিখতে চাই -  খুব দীর্ঘ এক চিঠি। কিন্তু সে আমার কেউ না, কেউ না। তার চোখে আমি নেই, আমার চোখে সে নেই। আমাদের ভেতর আমাদের মৃত্যু নেই। জানেন, আজো আমার জ্বর। আমার পাশে আমার মা নেই। কেউ নেই। আমি জ্বর নিয়ে কি যেন লিখছি। জ্বর হলে আগে আমি দুঃস্বপ্ন দেখতাম। একদিন জ্বরের দুঃস্বপ্নে আমার মা মারা গেলেন, আমি আর বাবা তাঁকে কবর দিয়ে এলাম-আর কাঁদতে কাঁদতে জেগে উঠলাম। জেগে দেখি আমার জ্বরের কপালে মায়ের শীতল আঙুল। আমি মাকে খুব ভালোবাসি, খুব – খুব – খুব। বাবাকেও। তবে মাকে কেন যেন একটু বেশি ভালোবাসি নিজের অজান্তে। কিন্তু বাবা আমার বন্ধু। মাকে ভয় পাই, মা বকেন এবং মারেন। বাবা মারেন না, বকেনও না। একদিন বাবা মেরেছিলেন, তারপর আমার প্রচণ্ড জ্বর হলো। বাবা তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন। এটা আমি আর বাবা জানি কেবল। ছোটকালে আমি একবার আত্মহত্যা করবো ভেবেছিলাম- কারণ বেঁচে থাকতে ভালো লাগতো না, কিন্তু মরে যেতেও ভালো লাগতো না। আসলে বেঁচে থাকা এবং মরে যাওয়া দুটোই বিরক্তিকর। ভেতরে লালন করি রক্তমাংশমন। ভেতরে দহন করি আঁধার আপন। আঙুলে স্পর্শ করি আঙুল আমার। এ কথা সত্য আমি একবার প্রেমে পড়েছিলাম। আসলে প্রেমে মানুষ পড়ে অর্থা মানুষের পতন হয়। প্রেমে পড়ার পর ভাবলাম বড়ো হয়ে গেছি আমি এখন সিগারেট খেতে পারি। কিন্তু সিগারেটে খুব র্দুগন্ধ এবং বিস্বাদ। তথাপি ভাবলাম বড়ো হয়ে গেলে সিগারেট খাওয়া যায় কেননা সিগারেট শব্দটা আমার পছন্দ এবং ধূয়া ছাড়াটাও। রাতে আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে সিগারেট খাচ্ছিলাম। মা এসে দরজা ধাক্কালে দরজা খুলে দিলে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সিগারেট খাচ্ছিস? তারপর আমাকে আর কিছুই না বলে দেয়ালে নিজের মাথা ঠুকতে থাকলেন। বাব এসেও আমাকে কিছু বললেন না। মাকে নিয়ে গেলেন। আমি একা একা বসে থাকলাম সারারাত জেগে থেকে। আমার আর সিগারেট খাওয়া হলো না। আমি এখন আঙুলগুলোকে সিগারেট ভেবে টেনে টেনে ধূয়া ছাড়ি। মাথার ভেতর ঘুম আর হরিতের ঘ্রাণ। আর কোন চিন্তা নেই। হারিয়ে যাওয়া যষ্টিমধুফুলের সংসার। কতগুলো দৃশ্য চোখের ভেতর। ফোন আসছে, কে যেন আমাকে ডাকে, হ্যালো, হ্যালো। একটা নাম্বার থেকে আমার খুব ফোন আসতো। ফোন ধরলে ওপাশ থেকে কেউ কথা বলতো না। খুব জানতে ইচ্ছে হলো ওপাশে কার নিঃশ্বাস পোড়ে। একটা নতুন সিম কিনে আমি ঐ নাম্বারে ফোন দিয়েছিলাম। একটা মেয়ে কণ্ঠ হ্যালো হ্যালো করলো, আমি তখন তার মতো চুপ করে ছিলাম। আরো একবার ফোন করলে সে আবারো হ্যালো হ্যালো বলে আর আমি চুপ করে থাকি। তারপর সে একটা গাল দিয়ে ফোন রেখে দিলো। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলাম। একটা সবুজ চুপচাপ গিলে খায় মদ। একটা হলুদ ঝেরে ফেলে জীবনের রঙ। বহুদূরে পাহাড় আছে, গারোপাহাড়। আরো দূরে শাদা মেঘের পাহাড়। স্কুল থেকে ফেরার পথে দুইটা পাহাড়ই আমাকে টানতো। গাছের ছায়ায় শুয়ে শুয়ে মেঘ দিয়ে পুতুল বানাতাম। যুদ্ধ খেলতাম। আর গারোপাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে পাহাড়ে চলে যাবো। আমার আঙুলে ব্যথা। তুমি কি বুঝতে পারো চিঠি পড়ে আঙুলের ক্ষয়?

বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন, ২০১১

কেউ আসে এবং যেতে হয়

হ্যাঁ, তার নাম ইমতিয়াজ আহমেদ। বয়স সত্তর এর কাছাকাছি। তিনি প্রতিদিন বিকালে বারান্দায় শুভ্র পোশাক পড়ে, সুগন্ধি মেখে, চকচকে কালো চামড়ার সেন্ডেল দুটি পায়ে দিয়ে, চলাচলের সুবিধার জন্য কেনা কালো লাঠিটি পাশে নিয়ে কারো জন্য অপেক্ষা করেন। একজন কেউ এসে তাকে কোথাও নিয়ে যাবে। তিনি তার প্রতীক্ষায় প্রতিদিন বসে থাকেন সারাটা বিকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ।

একমাত্র মেয়েটাকে বিয়ে দেয়ার পর তাদের আর কোন কাজই ছিলো না। হ্যাঁ, আমি ইমতিয়াজ সাহেব আর উনার স্ত্রীর কথা বলছি। চমৎকার এক বৃদ্ধা ছিলেন। হাসি-খুশি। এক কালে খুব সুন্দরী ছিলেন বেশ বোঝা যেত দেখে। শাদা চুল, শাদা শাড়ি আর ফর্সা মুখ খানি। মেয়েটাকে বিয়ে দেয়ার পর হঠাৎ তাদের ভেতর এক ধরণের অবসরের অনুভূতি চলে আসলো। আর কোন দায়িত্ব নেই। মফস্বল শহরের দুইতলার বাড়িটার দু'তলায় তারা দুজনের অবসর অবসর জীবন যাপন। তাও কেটে যাচ্ছিলো। মাঝে মাঝে মেয়েটা বেড়াতে আসতো। এবং তারা মেয়েটার বেড়ানো আসার প্রতীক্ষায় প্রতীক্ষায় বেঁচে থাকতো। কিন্তু মেয়েটা যখন তার স্বামীর সাথে দীর্ঘ ভ্রমনে দেশের বাইরে চলে গেলো তখন বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা দীর্ঘ প্রতীক্ষায় বসবাস করছিলেন। বৃদ্ধা দীর্ঘ প্রতীক্ষার পথে একদিন অনাকাঙ্খিতভাবে ইমতিয়াজ সাহেবকে আরো নিঃসঙ্গ করে চলে গেলেন। তারপর থেকেই ইমতিয়াজ সাহেব বিকাল বেলায় কারো আসার প্রতীক্ষায় বসে থাকেন। কারো আসার কথা ছিলো, কেউ আসবে।

এমনি এক বিকেল বেলায় যখন ইমতিয়াজ সাহেব অপেক্ষায় ছিলেন। কেউ আসবে এবং কেউ তাকে নিয়ে কোথাও যাবে। তখন তার বাসার মূল দরজায় কেউ নক করে। তিনি দরজা খুলে দিয়ে দেখেন ৫/৬ বছরের এক দেবশিশু দাঁড়িয়ে। তার সুন্দর হাস্যজ্জ্বোল মুখ। তিনি বিস্মিত হলেন। এই তবে! 'তোমার দরজা খুলতে এতক্ষন লাগে? ধুর! সরো, ভেতরে যাই।' ইমতিয়াজ সাহেব সরে দাঁড়ালেন। শিশুটি সারা ঘর কি যেন খুঁজে আসলো। 'এই, তোমার বাসায় আর কেউ নেই?' ইমতিয়াজ সাহেব কেন যেন ঘামছিলেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, না।
হুমম, তুমি কোথায় যাচ্ছো এতো সাজুগুজু করে?
না, কোথাও যাচ্ছি না।
কেন? চলো ঘুরে আসি। আমি তোমাদের নিচ তলার। আমি এখন থেকে এখানেই থাকবো স্কুলে ভর্তি হবো। চলো, চলো আমরা ঘুরে আসি।
তোমার নাম কি, খোকা?
আমার নাম দিতুল। তোমার নাম কি?
ইমতিয়াজ আহমেদ।
ও। তুমি কি বেড়াতে যাবে না?
যাবো। দাঁড়াও আসছি।

ঠিক ধরেছেন। ইমতিয়াজ সাহেব দিতুলকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেন। প্রতিদিন বিকালেই দিতুল চলে আসতো তার কাছে। তিনি তাকে নিয়ে খেলেন, বেড়াতে যান, ছবি আঁকা শেখেন, লেখাপড়া শেখেন।
বলতো ইংরেজি লেটার কয়টি?
ইমতিয়াজ সাহেব বলেন, ২৬টি।
আরে না ২৮ টি।
ইমতিয়াজ সাহেব বিভ্রান্ত হন। ২৬ টি না ২৮ টি? তিনি এ, বি, সি গুণতে থাকেন।
আরে, 'দ' আর 'ত' এর জন্য কোন লেটার রাখেনি। তাই ওদের জন্য আমি দুইটা লেটার বানিয়ে দিয়েছি। একটা 'দি' আর একটা 'তি'। 'দি' থাকবে 'ডি' এর পরে আর 'তি' থাকবে 'টি' এর পরে, বুঝছো? তাহলে 'দিতুল' লিখতে 'ডিটুল' লিখতে হবে না।

এভাবেই দিতুলকে নিয়ে ঘন্টা দুইয়েক সময় কাটানোর অপেক্ষায় থেকে থেকে তিনি একটি একটি করে দিন বেঁচে থাকছিলেন। একদিন বিকেল বেলায় দরজায় নক করলে তিনি দিতুল ভেবে দরজা খুলে দেখেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি নিজেই।
'কি ব্যাপার! তুমি তৈরি হওনি?' কালো পোশাক পড়া এবং কালোচশমায় চোখ ঢাকা ইমতিয়াজ সাহেব আমাদের ইমতিয়াজ সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন।
আমাদের ইমতিয়াজ সাহেব ঘামতে থাকেন।
'আচ্ছা, কাল তৈরি থেকো।' বলে চলে যান কালো ইমতিয়াজ সাহেব। তারপর দিতুল আসে। তিনি চিন্তিত থেকেই দিতুল এর সাথে বেড়াতে যান। দিতুলকে বলেন, তুমি আগামীকাল এসো না। আমি বাসায় থাকবো না।
'তুমি কোথায় যাবে?' দিতুল জানতে চায়।
ইমতিয়াজ সাহেব চুপ করে থাকেন।

পরদিন বিকালে ইমতিয়াজ সাহেব একটা ধারালো ছুরি হাতে দরজার সামনে বসে থাকেন। তিনি কোথাও যেতে চান না। একসময় দরজায় নক হয়। তিনি প্রচণ্ড ঘামছিলেন। তার চোখ দুটি লাল। তিনি ধারালো ছুরিটা শক্ত করে ধরে কাঁপতে কাঁপতে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।  

মঙ্গলবার, ২১ জুন, ২০১১

তার গ্রীবায় লেগে থাকে বিষণ্ণ সুন্দর

পালকের ফাঁকে ক্ষতের দঙ্গল
রক্তের আভায় ছড়িয়ে পড়ছে
ক্রোধান্ধ চোখ, চিবুকের
কাছে থরো থরো চিকার
ভাষাহীন অথচ কলহে
পুড়ে যাচ্ছে পুরোটা মানচিত্র;
আমি এর অনুবাদ জানি না।

প্রতিটি পতন পুলক আনে প্রেমের, কোন কোন পতনে মৃত্যু; মৃত্যু ও প্রেম সমগোত্রীয়।
সে প্রথম চোখে চোখ রাখলে চোখের ভেতর চাষ হয় স্বপ্নের
তার গ্রীবায় লেগে থাকে বিষণ্ণ সুন্দর, তার ঠোঁটের পাশে গন্ধমাখা হরিতের।
প্রথমবার চুম্বনে আমার পতন ঘটেছিলো, আমি তাকে মৃত্যু বলে জানি।

কবরস্থানের উল্টোদিকের পাড়াটায় এক চাঘরে বসে আছি। অদূরেই মূর্তিকারিগর নিপুন হাতে সুঢৌল করে দিচ্ছে প্রতিমার স্তন। তারপাশেই এক রমনী উনুনে ঢেলে দিচ্ছে রান্নার উপকরণ। ঘামে ভেজা তার শ্যামলা শরীর, লাল ব্লাউজ। জ্বল জ্বল করছে সিঁথির সিদূর, পানরসে লাল ঠোঁট। এক অন্ধ গায়েন সারিন্দায় তুলে আনছে সুর। সারিন্দার কাঠে বসে আছে পোষা কালো পাখি। গায়েনের নরোম মুখে অদ্ভুত স্মিত হাসি। একটি নগ্ন মেয়েশিশু মাটিতে বসে বসে খেলছে আপন মনে। একটা কাক মৃতপ্রাণীর নারিভুরী ছিঁড়ছে। একটা তরুণী জল ঢালছে আষাঢ়ের বৃষ্টিহীন তাপে পোড়া শরীরে। চানির্মাতার ঘামে ভেজা চিকচিকে কালো শরীর। পথচারী, রিকশা, সাইকেল আর একটা দোকানে মমতাজের স্বর। আর আমার মস্তিষ্ক জুড়ে একটা অবয়বহীন শুধু কণ্ঠস্বরের নারী। আমি তাকে চিঠি লিখি প্রতিদিন।

বৃহস্পতিবার, ১৬ জুন, ২০১১

ইথিলিয়াস, তোমার বন্ধু মরে গেছে আর আমি অন্ধ

সমস্ত শরীর ডুবিয়ে ঘন রক্ত থেকে ঝেড়ে ফেলছি অন্ধকারের রঙ। চাঁদ আর মেঘ মাখামাখি সুর। বাতাসে হরিতের ঘ্রাণ। একটা স্বরের তৃষ্ণায় কম্পমান আঙুল। দীর্ঘ শ্রবণ আর কল্পনায় আমার ভেতর কারো শূন্যতা। কেউ আমার কানে কানে ঢেলে দিয়েছে গুনগুন সুর। আমি বধির হয়ে গেছি।
রক্তের স্বাদে ভিজিয়ে দেব প্রচণ্ড সুন্দর, শিরায় শিরায় রক্তের নহর বাদ্যে জাগরুক, তোমার গান ফিরিয়ে নাও, আমাকে আহত করে নাবালিকা সুর, তুমি বরং একটা যন্ত্রণার চিঠি লেখো, প্রাপকের নামে আমার নাম লিখো, প্রিয় ফুরিয়ে যাওয়া দুপুর। তবে কি তার পূর্ণ হয়েছে রোদ? দুপুর ক্ষয়েছে দুপুর, অসুখে জীর্ণ মন। হারিয়ে গেছে অন্ধকারে প্রিয় শহর। তুমি আমাকে দহন করো, দহন করো। 
সে তার নামটা হারিয়ে ফেললো বলার ভাষার মতোই। কেউ কুড়িয়ে পেয়ে নামটা নিয়ে নিলো। ধরুণ তার নাম ছিলো 'থিও'। এখন প্রকৃত 'থিও' এবং নামধারী 'থিও' আমাদের সামনে দৃশ্যমান আমরা দুই দুইটা 'থিও' নিয়ে বিব্রত হবো। একজন প্রকৃতই থিও অন্যজন নয় তথাপি দুজনেরই স্বাতন্ত্রতা রয়েছে। আমরা থিও হিসাবে কাউকে অস্বীকার করি না। কেননা আর সকল কিছুর মতোই আমাদের শহরে দুইটা 'থিও' আমরা প্রত্যাশা করি। প্রকৃত অর্থে সকল শূন্যস্থান পূরণের লক্ষ্যে আমরা 'থিও' সঞ্চয় করি। 
সে যখন জেনে যাবে তার চোখ আমাদের চোখের চেয়ে বিষণ্ণতর তখন সে আমাদের চোখ পুড়িয়ে দেবে। আমরা আমাদের চোখে লুকিয়ে রাখি কাঁটাবন। আমাদের চারপাশের দৃশ্যগুলো পূর্ণ দেখার চোখ আমাদের নেই। অপূর্ণতা এক ধরণের আড়াল। আর আড়ালে সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। যারা পূর্ণ দেখে তারা আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার সহজ কোন পথ নেই, সেটা আমি জানি। আর এ জন্যই বস্তুত আমরা পরাধীন। আমরা কোনদিন নিঃশেষে বিভাজ্যের সূত্র জানবো না। 
নয়নতারা, কাঠবেলী অথবা টগর সংক্রান্ত জটিলতায় জড়িয়ে যাবার পর মনে হয় আমি আমার নাম ভুলে গেছি। কেউ আমাকে ছেড়ে গেছে তারাবাতি রাতে। তার চোখে ডুবে গেছে আমার সকল সুর। আমি তার জন্য বেঁচে থাকি। নিঃসঙ্গ চাঁদটাকে ঘিরে রেখেছে মেঘেরা, আড়াল থেকে মাঝে মাঝে সে আমাকে ডাকে, আমি জানলার গ্রিলে বন্দী নায়ক। আমি তার জন্যও বেঁচে থাকি। বুকের গহীনে ক্ষত চিরকাল। জানলাবন্ধ ঘরে আগন্তুক আলোয় নাড়ি হাতের আঙুল। তোমাকে স্পর্শ করিনি তবু জানি তোমার শরীরের উষ্ণতায় নিমজ্জিত ঠোঁট পুড়ে গেছে। যখন কেউ আমাকে প্রশ্ন করে আজ পূর্ণিমা কিনা, তখন আমি বলি
'আমি অন্ধ হয়ে গেছি'।


 ইথিলিয়াস, তোমার বন্ধু মরে গেছে আর আমি অন্ধ


বৃহস্পতিবার, ৯ জুন, ২০১১

চোখ খেয়ে গেছে মৃত দৃশ্য

আমার ঘরের জানলাটার কপাট ছিলো না, আর তার জানলাই ছিলো না। আমরা প্রতিদিন ঘুম থেকে জেগে চাঘরটাতে গিয়ে বসতাম। সেখানের সকালের রোদ, বলকওঠা শাদা দুধের বাষ্পে ও ধুয়ায় আমরা আমাদের জানলার চিন্তাগুলো বিনিময় করতাম। আমরা আমাদের চোখে জানলার চিত্র আঁকতাম। সেখানে এক তরুণী মা এসে তার বাচ্চাটার জন্য এক পেয়ালা দুধ নিয়ে যেত। আমাদেরও উঠতি বয়সের দোষ ছিলো। আমরাও সেই তরুণীর দুধ নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতাম। সে যখন দুধ নিতে আসতো তখন সে দুধের পেয়ালাটা দোকানদারকে দিয়ে আমাদের চোখচারটিকে তার দুচোখ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো। আমাদের দৃষ্টি তার চোখে আটকে রাখতো। আমরা বিব্রতবোধ করতাম, ক্লান্তি বোধ করতাম, খুব রেগে যেতাম ভেতরে ভেতরে। আমরা ভাবতাম আমাদের দৃষ্টিকে আমরা স্বাধীন রাখতেই পারি। আমাদের বিদ্রোহী হয়ে উঠতে ইচ্ছে করতো। কিন্তু আমার জানলার কপাট আর তার জানলা না থাকার বিষয়টা আরো জটিল হয়ে ওঠায় আমরা পরাধীনতা মেনে নেই।
কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার উপায় থাকে না যে চোখবন্দী সময়গুলোতে আমাদের মস্তিষ্কের ভেতর অদ্ভুত অনুভূতি হয়। সে বলে, দোস্ত কইচ না আমি শেষ।
আমি বলি, আইচ্ছা আমি কমু না। সে তখন হাই তুলে, হাত মেলে টানা দেয়। আমি আমার ডান হাতের আঙুলগুলো দিয়ে মাথার চুলে বিলি কেটে নেই। তারপর সে বলে, জানলা হইলো জানলা, বুঝচসআমি বলি, হুমম, জানলা হইলো জানলা। তার শ্যামলা কড় পড়া হাত মেলে ধরে বলে, দেখ আমার হাতে পাঁচটা জানলা। তারপর হাতের তালুতে পাঁচটা হাতের রেখা দেখায়। আমি বলি, হুমম, দেখচে আমার কয়টা? আমি আমার ডান হাত বাড়িয়ে দেই। সে দেখে। তারপর বলে, নাই, তোর কোন জানলা থাকার কথা না। আমি বলি, ভুয়া। আমারতো একটা জানলা আছেই, কেবল এর কপাট নেই। সে বলে, ঐটা তাইলে জানলা না। আমি তার দিকে বিরক্ত বোধ করি। তাকে হিংসুটে মনে হতে থাকে। তার পাঁচটা আর আমার কোন জানলা না থাকার গল্প ফাঁদার জন্য তাকে তিরস্কার করি। সে হা হা হা করে হাসে। আমার হাসি আসে না। আমি হাসতে পারি না।
ঘরে ফিরে এসে কপাটহীন জানলাটার চারপাশ ভালো করে দেখি। হাত রাখি। এটা কি জানলা নাকি কোন ফোকর! আমার এতোদিন পর সন্দেহ হয়। আমি জানলার ফোকরটা দিয়ে ওপাশের বিশাল দালানের রঙ করা দেয়াল দেখি। আকাশ দেখা যায় না। জানলা দিয়ে হাত বাড়ানো যায় না। কোনদিন বৃষ্টির ছাট আসে না। তাই কি? এটা আমার জানলা। এটা আমার জানলা। আমার সারা রাত ঘুম হয় না। আমি জেগে জেগে জানলা দেখি আর পাশের দালানের রঙটা কে জোছনা কল্পনা করি।
সকালে চাঘরটায় সে আমাকে দেখে আকে ওঠে, কি হইছে তোর? জিজ্ঞেস করে। আমি গুনগুন গান করি। তারপর চা খাই। তরুণীটি দুধ নিতে আসে। সে তার চোখ নিয়ন্ত্রণ করে, আমার চোখ নিয়ন্ত্রণ করে না। আমি মুক্ত দৃষ্টিতে দেখি। আমার বিভ্রম হয়। আমি দেখি একটা দীর্ঘ জানলায় কাচের শার্ষির ফাঁক গলে এক গোছা রাজকুমারীর দীর্ঘ চুল। আমি তরুণীর সেই গোছা গোছা চুলে হাত রেখে জানলার দিকে উঠতে থাকি। একটা সুঘ্রাণে ডুবে যেতে থাকি। তরুণীটি দুধের পেয়ালা হাতে চলে যেতে থাকে। তার চুল আমার হাত থেকে দীর্ঘ হতে থাকে। আমার বন্ধুটি আমার দিকে বিভ্রান্ত হয়ে তাকিয়ে থাকে। আমি তার চোখে একটা জানলার দৃশ্য ঝুলিয়ে দিয়ে বলি, বন্ধু, আজ সকালে আমি আত্মহত্যা করেছি।

সোমবার, ৬ জুন, ২০১১

আয়না অথবা চোখ

আয়না ভেঙ্গে গেলে আপনি মুখ দেখবেন কোথায়কেবল আয়নার ভেতরই আপনি থাকেন। মস্তিষ্কের ভেতর প্রেত। প্রেতেরা উঠোনে চিৎকার করে আর সুর করে কাদেঁ। বস্তুত সকল সুর প্রার্থনার আহ্বান। আহ্বান আর জিহ্বার উচ্চারণ আওভান আর জিওভা। জিহ্বা পুড়ে গেলে বুঝতে হবে আপনি গরম চা পান করেছেন। চায়ের কাপে করে আপনি জলও পান করতে পারেন। জলে নিজের চোখও ভাসিয়ে নিতে পারেন। চোখের প্রতিশব্দ নয়ন। তবে নয়নের প্রতিশব্দ চোখ নাও হতে পারে। আপনি নয়নে কাজল টানতে পারেন তবে খেয়াল করবেন কাজল কিন্তু কালো। কালো হলেই কৃষ্ণ নয়। কৃষ্ণচূড়া কিন্তু লাল। রক্তও লাল। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন আপনার আঙুল ফেটে রক্ত ঝরছে, কিবোর্ডটা ভিজিয়ে ফেলছেন রক্তে আর আপনি ক্রমশ অন্ধ ও বোবা। 
অন্ধ
চোখ
স্মৃতি
স্মৃতিগুলো মুছে ফেলছেন আর ভাবছেন ডুবে যাচ্ছে চোখ। কিছুক্ষণ পরেই ডুবুরিরা চোখে নেমে আপনাকে নিয়ে আসবে আপনি পালাতে চাইলে আপনাকে তারা ডুবিয়ে মারবে। আপনি ইচ্ছে করলে সাঁতার শিখে নিতে পারেন। সাঁতার শিখতে হলে আপনাকে একটা এস্রাজ কিনতে হবে। কীবোর্ডে আঙুল বসে যাবে। এস্রাজ ছাড়া আপনি সাঁতার শিখতে পারবেন না। আপনার আঙুল খসে পড়বে। আপনি দেখুন আপনার হাতের দশটি আঙুল দশটি মানুষের মতো কাঁদছে কারণ আপনি এস্রাজ চেনেন না। আপনার কানের কাছে একটা ঘুন পোকা রাত কেটে কেটে ক্লান্ত। আপনার কণ্ঠনালী ছিঁড়ে গিয়ে একটা নষ্ট গিটার। আফসোস আপনার কোন আয়না নাই। আপনাকে আপনার ছায়া দেখালামতারপরও আপনি বলেন আপনার ছায়া নেই! আহারে!