বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন, ২০১১

কেউ আসে এবং যেতে হয়

হ্যাঁ, তার নাম ইমতিয়াজ আহমেদ। বয়স সত্তর এর কাছাকাছি। তিনি প্রতিদিন বিকালে বারান্দায় শুভ্র পোশাক পড়ে, সুগন্ধি মেখে, চকচকে কালো চামড়ার সেন্ডেল দুটি পায়ে দিয়ে, চলাচলের সুবিধার জন্য কেনা কালো লাঠিটি পাশে নিয়ে কারো জন্য অপেক্ষা করেন। একজন কেউ এসে তাকে কোথাও নিয়ে যাবে। তিনি তার প্রতীক্ষায় প্রতিদিন বসে থাকেন সারাটা বিকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ।

একমাত্র মেয়েটাকে বিয়ে দেয়ার পর তাদের আর কোন কাজই ছিলো না। হ্যাঁ, আমি ইমতিয়াজ সাহেব আর উনার স্ত্রীর কথা বলছি। চমৎকার এক বৃদ্ধা ছিলেন। হাসি-খুশি। এক কালে খুব সুন্দরী ছিলেন বেশ বোঝা যেত দেখে। শাদা চুল, শাদা শাড়ি আর ফর্সা মুখ খানি। মেয়েটাকে বিয়ে দেয়ার পর হঠাৎ তাদের ভেতর এক ধরণের অবসরের অনুভূতি চলে আসলো। আর কোন দায়িত্ব নেই। মফস্বল শহরের দুইতলার বাড়িটার দু'তলায় তারা দুজনের অবসর অবসর জীবন যাপন। তাও কেটে যাচ্ছিলো। মাঝে মাঝে মেয়েটা বেড়াতে আসতো। এবং তারা মেয়েটার বেড়ানো আসার প্রতীক্ষায় প্রতীক্ষায় বেঁচে থাকতো। কিন্তু মেয়েটা যখন তার স্বামীর সাথে দীর্ঘ ভ্রমনে দেশের বাইরে চলে গেলো তখন বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা দীর্ঘ প্রতীক্ষায় বসবাস করছিলেন। বৃদ্ধা দীর্ঘ প্রতীক্ষার পথে একদিন অনাকাঙ্খিতভাবে ইমতিয়াজ সাহেবকে আরো নিঃসঙ্গ করে চলে গেলেন। তারপর থেকেই ইমতিয়াজ সাহেব বিকাল বেলায় কারো আসার প্রতীক্ষায় বসে থাকেন। কারো আসার কথা ছিলো, কেউ আসবে।

এমনি এক বিকেল বেলায় যখন ইমতিয়াজ সাহেব অপেক্ষায় ছিলেন। কেউ আসবে এবং কেউ তাকে নিয়ে কোথাও যাবে। তখন তার বাসার মূল দরজায় কেউ নক করে। তিনি দরজা খুলে দিয়ে দেখেন ৫/৬ বছরের এক দেবশিশু দাঁড়িয়ে। তার সুন্দর হাস্যজ্জ্বোল মুখ। তিনি বিস্মিত হলেন। এই তবে! 'তোমার দরজা খুলতে এতক্ষন লাগে? ধুর! সরো, ভেতরে যাই।' ইমতিয়াজ সাহেব সরে দাঁড়ালেন। শিশুটি সারা ঘর কি যেন খুঁজে আসলো। 'এই, তোমার বাসায় আর কেউ নেই?' ইমতিয়াজ সাহেব কেন যেন ঘামছিলেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, না।
হুমম, তুমি কোথায় যাচ্ছো এতো সাজুগুজু করে?
না, কোথাও যাচ্ছি না।
কেন? চলো ঘুরে আসি। আমি তোমাদের নিচ তলার। আমি এখন থেকে এখানেই থাকবো স্কুলে ভর্তি হবো। চলো, চলো আমরা ঘুরে আসি।
তোমার নাম কি, খোকা?
আমার নাম দিতুল। তোমার নাম কি?
ইমতিয়াজ আহমেদ।
ও। তুমি কি বেড়াতে যাবে না?
যাবো। দাঁড়াও আসছি।

ঠিক ধরেছেন। ইমতিয়াজ সাহেব দিতুলকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেন। প্রতিদিন বিকালেই দিতুল চলে আসতো তার কাছে। তিনি তাকে নিয়ে খেলেন, বেড়াতে যান, ছবি আঁকা শেখেন, লেখাপড়া শেখেন।
বলতো ইংরেজি লেটার কয়টি?
ইমতিয়াজ সাহেব বলেন, ২৬টি।
আরে না ২৮ টি।
ইমতিয়াজ সাহেব বিভ্রান্ত হন। ২৬ টি না ২৮ টি? তিনি এ, বি, সি গুণতে থাকেন।
আরে, 'দ' আর 'ত' এর জন্য কোন লেটার রাখেনি। তাই ওদের জন্য আমি দুইটা লেটার বানিয়ে দিয়েছি। একটা 'দি' আর একটা 'তি'। 'দি' থাকবে 'ডি' এর পরে আর 'তি' থাকবে 'টি' এর পরে, বুঝছো? তাহলে 'দিতুল' লিখতে 'ডিটুল' লিখতে হবে না।

এভাবেই দিতুলকে নিয়ে ঘন্টা দুইয়েক সময় কাটানোর অপেক্ষায় থেকে থেকে তিনি একটি একটি করে দিন বেঁচে থাকছিলেন। একদিন বিকেল বেলায় দরজায় নক করলে তিনি দিতুল ভেবে দরজা খুলে দেখেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি নিজেই।
'কি ব্যাপার! তুমি তৈরি হওনি?' কালো পোশাক পড়া এবং কালোচশমায় চোখ ঢাকা ইমতিয়াজ সাহেব আমাদের ইমতিয়াজ সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন।
আমাদের ইমতিয়াজ সাহেব ঘামতে থাকেন।
'আচ্ছা, কাল তৈরি থেকো।' বলে চলে যান কালো ইমতিয়াজ সাহেব। তারপর দিতুল আসে। তিনি চিন্তিত থেকেই দিতুল এর সাথে বেড়াতে যান। দিতুলকে বলেন, তুমি আগামীকাল এসো না। আমি বাসায় থাকবো না।
'তুমি কোথায় যাবে?' দিতুল জানতে চায়।
ইমতিয়াজ সাহেব চুপ করে থাকেন।

পরদিন বিকালে ইমতিয়াজ সাহেব একটা ধারালো ছুরি হাতে দরজার সামনে বসে থাকেন। তিনি কোথাও যেতে চান না। একসময় দরজায় নক হয়। তিনি প্রচণ্ড ঘামছিলেন। তার চোখ দুটি লাল। তিনি ধারালো ছুরিটা শক্ত করে ধরে কাঁপতে কাঁপতে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন