বৃহস্পতিবার, ৯ জুন, ২০১১

চোখ খেয়ে গেছে মৃত দৃশ্য

আমার ঘরের জানলাটার কপাট ছিলো না, আর তার জানলাই ছিলো না। আমরা প্রতিদিন ঘুম থেকে জেগে চাঘরটাতে গিয়ে বসতাম। সেখানের সকালের রোদ, বলকওঠা শাদা দুধের বাষ্পে ও ধুয়ায় আমরা আমাদের জানলার চিন্তাগুলো বিনিময় করতাম। আমরা আমাদের চোখে জানলার চিত্র আঁকতাম। সেখানে এক তরুণী মা এসে তার বাচ্চাটার জন্য এক পেয়ালা দুধ নিয়ে যেত। আমাদেরও উঠতি বয়সের দোষ ছিলো। আমরাও সেই তরুণীর দুধ নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতাম। সে যখন দুধ নিতে আসতো তখন সে দুধের পেয়ালাটা দোকানদারকে দিয়ে আমাদের চোখচারটিকে তার দুচোখ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো। আমাদের দৃষ্টি তার চোখে আটকে রাখতো। আমরা বিব্রতবোধ করতাম, ক্লান্তি বোধ করতাম, খুব রেগে যেতাম ভেতরে ভেতরে। আমরা ভাবতাম আমাদের দৃষ্টিকে আমরা স্বাধীন রাখতেই পারি। আমাদের বিদ্রোহী হয়ে উঠতে ইচ্ছে করতো। কিন্তু আমার জানলার কপাট আর তার জানলা না থাকার বিষয়টা আরো জটিল হয়ে ওঠায় আমরা পরাধীনতা মেনে নেই।
কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার উপায় থাকে না যে চোখবন্দী সময়গুলোতে আমাদের মস্তিষ্কের ভেতর অদ্ভুত অনুভূতি হয়। সে বলে, দোস্ত কইচ না আমি শেষ।
আমি বলি, আইচ্ছা আমি কমু না। সে তখন হাই তুলে, হাত মেলে টানা দেয়। আমি আমার ডান হাতের আঙুলগুলো দিয়ে মাথার চুলে বিলি কেটে নেই। তারপর সে বলে, জানলা হইলো জানলা, বুঝচসআমি বলি, হুমম, জানলা হইলো জানলা। তার শ্যামলা কড় পড়া হাত মেলে ধরে বলে, দেখ আমার হাতে পাঁচটা জানলা। তারপর হাতের তালুতে পাঁচটা হাতের রেখা দেখায়। আমি বলি, হুমম, দেখচে আমার কয়টা? আমি আমার ডান হাত বাড়িয়ে দেই। সে দেখে। তারপর বলে, নাই, তোর কোন জানলা থাকার কথা না। আমি বলি, ভুয়া। আমারতো একটা জানলা আছেই, কেবল এর কপাট নেই। সে বলে, ঐটা তাইলে জানলা না। আমি তার দিকে বিরক্ত বোধ করি। তাকে হিংসুটে মনে হতে থাকে। তার পাঁচটা আর আমার কোন জানলা না থাকার গল্প ফাঁদার জন্য তাকে তিরস্কার করি। সে হা হা হা করে হাসে। আমার হাসি আসে না। আমি হাসতে পারি না।
ঘরে ফিরে এসে কপাটহীন জানলাটার চারপাশ ভালো করে দেখি। হাত রাখি। এটা কি জানলা নাকি কোন ফোকর! আমার এতোদিন পর সন্দেহ হয়। আমি জানলার ফোকরটা দিয়ে ওপাশের বিশাল দালানের রঙ করা দেয়াল দেখি। আকাশ দেখা যায় না। জানলা দিয়ে হাত বাড়ানো যায় না। কোনদিন বৃষ্টির ছাট আসে না। তাই কি? এটা আমার জানলা। এটা আমার জানলা। আমার সারা রাত ঘুম হয় না। আমি জেগে জেগে জানলা দেখি আর পাশের দালানের রঙটা কে জোছনা কল্পনা করি।
সকালে চাঘরটায় সে আমাকে দেখে আকে ওঠে, কি হইছে তোর? জিজ্ঞেস করে। আমি গুনগুন গান করি। তারপর চা খাই। তরুণীটি দুধ নিতে আসে। সে তার চোখ নিয়ন্ত্রণ করে, আমার চোখ নিয়ন্ত্রণ করে না। আমি মুক্ত দৃষ্টিতে দেখি। আমার বিভ্রম হয়। আমি দেখি একটা দীর্ঘ জানলায় কাচের শার্ষির ফাঁক গলে এক গোছা রাজকুমারীর দীর্ঘ চুল। আমি তরুণীর সেই গোছা গোছা চুলে হাত রেখে জানলার দিকে উঠতে থাকি। একটা সুঘ্রাণে ডুবে যেতে থাকি। তরুণীটি দুধের পেয়ালা হাতে চলে যেতে থাকে। তার চুল আমার হাত থেকে দীর্ঘ হতে থাকে। আমার বন্ধুটি আমার দিকে বিভ্রান্ত হয়ে তাকিয়ে থাকে। আমি তার চোখে একটা জানলার দৃশ্য ঝুলিয়ে দিয়ে বলি, বন্ধু, আজ সকালে আমি আত্মহত্যা করেছি।

1 টি মন্তব্য:

  1. আজ সকালে আমি আত্মহত্যা করেছি।
    - সম্ভবতঃ এখানেই সব বলা হয়ে গেছে। এ ধরণের লেখা আমার ভাল লাগে।

    উত্তরমুছুন