মঙ্গলবার, ২৮ জুন, ২০১১

ইতিন

বাদর ছেলেটা সকাল থেকে একবারও খাবার দেয়নি। রিচুকে পটকু এক দানা খাবার বের করে দিয়েছে মুখ থেকে। পটকু একটা রাক্ষস আর ধুরন্দর। খাবার দেয়ার সাথে সাথে দানা দানা খাবার মুখের মাঝে পুরে ফেলে। দুএকটা দানা মুখের মাঝে জমিয়ে রাখে। রিচুকে সে খাবার দিয়ে দিয়ে তার বন্ধু বানিয়ে নিয়েছে। রিচুটাও কী হ্যাঙলারে বাবা! পটকু, রিচু এ্যাকুরিয়ামের একপাশে বসে কি যেন পুনুর পুনুর করছে। হ্যাবলা কালোটা ঝিমিয়ে আছে। আমি একা একা খাবারের জন্য বসে আছি। উফ ক্ষুধায় কিচ্ছু ভালো লাগছে না।ইতিন যখন এমনটি ভাবছিলো। তখনই ছেলেটা এ্যাকুরিয়ামের দিকে আসলো। পটকু আর রিচু তখন নিজেদের আলাপে মশগুল। ইতিন ভাবলো ছেলেটা খাবার দিতে এসেছে। সে সাঁতরিয়ে উপরের দিকে উঠে এলো। আর উপরে উঠতেই ছেলেটা দুই হাত দিয়ে খপ করে তাকে ধরে উপরে নিয়ে আসলো। উরে বাবা!বলে ইতিন একটা চিকার করতে পারলো। সে চিকার রিচু শুনলো কি না কে জানে!
তখন খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো। ছেলেটা ইতিনকে ধরে এনে কাদা জলে ছেড়ে দিলো। জল পেয়ে শ্বাস নিলো ইতিন। কিন্তু এই নোংরা জলে তার ঘেন্না করতে লাগলো। সে পুরো বিষয়টায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। সামনে একটুকরা খাবার ছিলো, নোংরা খাবার। সেটাই সে খেয়ে নিলো গপ করে। ছেলেটা তাকে তাড়া করছিলো সাঁতার কাটার জন্য। সে কিছুক্ষণ সাঁতার কাটালো। হঠা একটা কালো মাছের বাচ্চা দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বললো, এই যে, আসো আমার সাথে হুদোল ছুঁচোটা তোমাকে মেরে ফেলবে, পালাও, গিচুং গিচুং। ইতিন এই বিষয়টাও বুঝলো না আর ‌‘গিচুং গিচুংও বুঝলো না।তবু জীবনের মায়ায় কালো মাছের বাচ্চাটার পেছনে সাঁতরাতে লাগলো। কালো মাছের বাচ্চাটা খুব দ্রুত সাঁতরায়। আর সাঁতরাতে সাঁতরাতে গ্যা, গুচ করে বাঁক নেয়। ইতিন কিছুই লক্ষ্য না করে অনেকক্ষণ কালো মাছের বাচ্চার পেছন পেছন সাঁতরিয়ে এলো। একসময় কালো মাছের বাচ্চাটা থেমে গেলো। ইতিনও হাঁফাতে হাঁফাতে থামলো কিংবা থেমে হাঁফাতে লাগলো। তুমি ওই হুদোলটার হাতে পড়লে কি করে?’ চোখ নাচিয়ে কালো মাছের বাচ্চা জানতে চায়। ইতিন কিছু না বলে জানতে চায়, তোমার নাম কি?
কালো মাছের বাচ্চাটা একটা ঘূর্ণি কেটে লেজটাকে দুএকটা মোচড় দিয়ে গলাটাকে গম্ভির করে বলে, ‘আমার নাম রুফি টাকি। তোমার নাম কি?’
ইতিন।
এটা আবার কেমন নামরে বাবা! ভুশশশশ
ইতিন হেসে ফেললো- কেন? নামটা সুন্দর না?
হুমমম, সুন্দর, কিন্তু তোমার গায়ের রঙ এমন হলো কি করে? এতো সোনালি! তোমার মতো এমন গায়ের রঙ আগে কারো দেখিনি।
ও।
ইতিনের হঠা মন খারাপ হলো। রিচু, পটকু আর কালো ভ্যাবলাটার জন্য তার মনটা কেমন করতে থাকলো। আহারে রিচু, পটকু, ভ্যাবলা! তাদের সাথে আর জীবনে দেখা হবে কি না কে জানে!
গ্যাচুং, গ্যাচুং তুমি এতো কি ভাবো? জানতে চায় রুফি।
ইতিন বলে, কিছু না।
চলো আমার সাথেবলেই রুফি চলতে শুরু করে। ইতিন তার পেছন পেছন চলে। এটা একটা নর্দমা। নোংরা পানিতে গা ঘিন ঘিন করছিলো ইতিনের। কিন্তু একটু সময়েই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। বৃষ্টি হওয়ায় পানির খুব স্রোত। স্রোত কেটে কেটে রিফুর পেছনে পেছনে এগিয়ে চলে ইতিন। পথে চলতে চলতে একটা পুঁটি মাছের সাথে দেখা হয়। রিফু তাকে মাথা দিয়ে ঢুঁশ দেয়। ঢুঁশ খেয়ে পুঁটিটা হাসতে হাসতে শেষ। ইতিনকে দেখে বাঁকা চোখে তাকায়। রিফুর কাছে জানতে চায়, এটা কে রে? রিফু বলে, ও ইতিন, আমার বন্ধু। নতুন এসেছে। পুঁটিটা এসে ইতিনের গা শুঁকে। তারপর বলে, বেশ সুন্দর, বেশ সুন্দর। তারপর হেঁড়ে গলায় গান ধরে আমার ভিন দেশী তারা.... । আর হাসতে হাসতে চলে যেতে থাকে। ও খুব ভালোবললো রিফু। ইতিন উদাস কন্ঠে বলে, ‘'কিছু দিন আগে সে তার বাবা-মাকে হারিয়ে ফেলছে। এখন সে একা একা থাকে।'
ইতিনের মনটাও খারাপ হয়ে যায়, তার মনে হয়, সেও তো একা।
কিছুটা পথ যেতেই রিফুর মতো দেখতে তিনটা মাছ এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়। তাদের একটা রিফুকে জিজ্ঞেস করে, ওই রিপ্যুা, তোর লগে এইডা কেডারে?
আমার বন্ধু ইতিন।
ওরা এসে ইতিনের চারপাশে ঘোরপাক খায়। ইতিনের ভালো লাগে না। রিফু বলে, চলো ইতিন।
মাছ তিনটা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। রিফু তাদের সাথে আর কথা বলে না। তারাও রিফুর সাথে কথা না বলে গুম মেরে থাকে।
(
২রা জুন, ২০১১)

ইতিনকে নিয়ে রিফু নর্দমার একটা ফোকরে ঢুকে পড়ে। এসো, এটা আমাদের বাসা।বলে নিয়ে যায় ভেতরে। ইতিন খুব বিব্রত বোধ করে। এ রকম পরিস্থিতির স্বীকার সে জীবনেও হয়নি। ভাবনার অতীত একটা কাণ্ড ঘটে গেলো তার জীবনে। রিফুকে দেখে ছুটে আসে দুইজন, একটি ছেলে আর একটি মেয়ে টাকি মাছ। দুজনই রিফুর চেয়ে বয়সে ছোট। ইতিনকে দেখে তারাও বিস্মিত হয়। রিফু পরিচয় করিয়ে দেয় ইতিনের সাথে তার ছোট ভাই জিফুও বোন সাইফুকে। কোণের অন্ধকার থেকে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে আসেন, ‘রিফু, তুমি কি স্কুল থেকে ফিরলে?... আরে .. এ কে?’ রিফু ইতিনকে তার দাদুর সাথেও পরিচয় করিয়ে দিলো। দাদুকে সব খুলে বললো। দাদুর কপালে চিন্তার রেখা দেখা গেলো। তাহলে বলতে চাচ্ছো, ইতিনের কেউ নেই?’
হ্যাঁ, তাই।বললো রিফু। সে তবে আমাদের এখানেই থাকবে?’ দাদু জানতে চায়লো। রিফু ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। বাবাহীন চার জনের সংসার মা একা টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। এখানে ইতিনের থাকাটা বাড়তি ঝামেলাই। রিফু ইতিনের সামনে লজ্জায় মাথা নত করে রাখলো। ইতিনও বিব্রত অবস্থায় কি বলবে বা কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিলো না। দাদু তখন হা হা করে হেসে বললেন, ইতিন আমাদের এখানেই থাকবে। ইতিন আমাদের পরিবারেরই একজন। জিফু আর সাইফু লাফিয়ে উঠলো আনন্দে। কিন্তু রিফু, ইতিন আর দাদুর ভেতরে ভেতরে ঠিকই একটা অস্বস্তি গুম হয়ে থাকলো। অনেকটা সময় তারা সহজ হতে পারলো না।
আরো কিছুক্ষণ পর রিফুর মা বাসায় ফিরলো। ইতিন একটা কোণে চুপটি করে বসেছিলো। রিফু তার বাড়ির কাজ করছিলো। জিফু আর সাইফু কি যেন খেলছিলো। আর দাদু একটা কাগজে কি যেন আঁকি-বুকি করছিলো। রিফুর মা খুব মোলায়েম কণ্ঠে তার সন্তানদের নাম ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকলেন। প্রথমে ইতিনকে তিনি খেয়াল করেননি। কারণ ইতিন অন্ধকার কোণটায় বসেছিলো। জিফু আর সাইফু দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। তাদের মা তাদের আদর করলেন। রিফু চুপ করে বাড়ির কাজের খাতায় অঙ্ক করছিলো। তাকে চুপ দেখে মা তার দিকে এগিয়ে এলেন। কিরে স্কুলে মার খেয়েছিস? এতো চুপচাপ কেনো?’ তখনই চোখে পড়লো ইতিনকে। বাহ্ কি সুন্দর! কে গো তুমি?’ জিজ্ঞেস করলো ইতিনকে। ইতিন মাথা নিচু করে জবাব দিলো আমি ইতিনভারী মিস্টি নামতোমা এগিয়ে গেলেন ইতিনের দিকে পাখনা দিয়ে আদর করে দিলেন। তখন দাদু তার ভাঙ্গা চশমাটা খুলে মুছতে মুছতে বললেন, বৌমা ইতিনের মতো আমার এক বন্ধু ছিলো বুঝলে, তার নাম ছিলো রৈরাঙ বেলে। ঠিক ইতিনের মতো নয় কিন্তু সোনালি দাগ কাটা। তো বিষয়টা হচ্ছে কি জানো? ....’ দাদু মাকে ইতিনের বিষয়টা সময় নিয়ে গুছিয়ে বললেন। ইতিন ও রাফু এবং দাদু মনে করেছিলো মা রাগ করবেন এবং ইতিনকে এখানে থাকতে দিবেন না। কিন্তু মা কিছুই বললেন না। সব শুনে ইতিনকে কাছে টানলেন, আদর করে দিলেন। বললেন, ‘তুমি আমার আরেকটা ছেলে।ইতিনকে কেউ এভাবে আদর করেনি আগে। কি এক অদ্ভুত কারণে তার চোখ ভেঙ্গে কান্না আসতে লাগলো। রিফু মার কথা শুনে দৌড়ে এসে ইতিনকে জড়িয়ে ধরলো, তা দেখে জিফু আর সাইফুও এসে ইতিনকে জড়িয়ে ধরলো।
রাতে খাওয়া-দাওয়ার সময় ইতিন কিছুই খেতে পারলো না। সে তার সারা শরীরে ব্যথা অনুভব করতে থাকলো। দাদু বললেন আবহাওয়ার পরিবর্তনে ইতিনের এই ধরণের সমস্যা হচ্ছে। ঠিক করা হলো সকালে কাকিলা ডাক্তারকে ডেকে আনা হবে। ইতিন প্রচণ্ড জ্বর কিন্তু অদ্ভুত আনন্দ নিয়ে রিফু, জিফু আর সাইফুর সাথে ঘুমুতে গেলো।
সকালে ঘুম থেকে জেগে কাঁথা গায়ে দিয়ে বসে থাকলো ইতিন। মা ঘরের কাজগুলো সারছিলেন। জিফু আর সাইফু ঘুম ভাঙ্গা অবসন্নতা নিয়ে চুপচাপ বসে ছিলো। দাদু দীর্ঘ সময় ধরে তার দাঁতগুলো পরিষ্কার করে শাদা চুলগুলো আঁচড়ালেন। তখনি রিফু কাকিলা ডাক্তারকে নিয়ে হাজির হলো। ইতিন এ রকম ভয়াবহ আকারের মাছ আগে দেখেনি। সামনে অনেকগুলো দাঁত। তবে বুড়ো হয়ে যাওয়ায় কিছু দাঁত পড়ে গেছে। কথা স্পষ্ট উচ্চারিত হয়না, কিহে, টাক্কু তোমাদের আবার কার অসুখ হলো? দাদুর বন্ধু কাকিলা ডাক্তার। দাদুর টাক নেই। তবু টাকি মাছের জন্য তাকে টাক্কু বলে ডাকেন। দাদু ইতিনকে দেখিয়ে দিলেন আমার নাতি, দেখোতো কি হইলো?’ অনেকক্ষণ তিনি ইতিনকে দেখলেন। জিহ্বা, চোখ, নারী নক্ষত্র। তারপর বললেন, ঠিক হয়ে যাবে। এরপর ইতিনের একটা পাখনায় একটা দাঁতদিয়ে কামড়ে দিলেন। ইতিনের খুব ঘুম পেতে থাকলো। কিন্তু সে ঘুমালো না। ঘুম ঘুম আবেশে থেকে সে শুনতে পেলা ছাড়া ছাড়া কিছু কথা- নদীতে যাওয়ার ম্যাপটা আমার ঠিক আছেহ্যাঁ, তারাইতো আন্দোলন করলো তত্বাবধায়ক সরকারের জন্য।’ ‘সংসদে না গিয়ে চিল্লা-পাল্লা আর হরতাল করে কি লাভ, ওরা বসে সমস্যা সমাধান করুক। এরপর একটা গভীর ঘুমে ইতিন তলিয়ে গেলো।
(
২৯ জুন, ২০১১)

আশা রাখি এই গল্পটা এই পোস্টেই বিবর্ধিত হবে ক্রমে .....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন