রবিবার, ১২ আগস্ট, ২০১২

দণ্ডিত মৃত্যুর দিকে

  চমৎকার সব গল্প বলে জমিয়ে তুলছিলাম আসর। রাজকন্যা আর রাজপুত্রের গল্প শুনিয়ে প্রচণ্ড বাহবা পেলাম। ঘুঘু পাখি আর নীল তিমির গল্পেও তাদের প্রীত দেখি। আমিও উচ্ছ্বসিত হয়ে আমার ঝোলা থেকে একের পর এক গল্প বের করে ছুড়ে দিতে লাগলাম শ্রোতাদের দিকে বিস্ময়কর জাদুকরের মতো। দুঃখিনী রাজকন্যার গল্প শুনে কেঁদে বুক ভাসালো রমনীকুল। দয়ালু রাজার গল্প শোনার পর নগরপতি আমার দিকে ছুড়ে দিলো স্বর্ণমুদ্রা। মন্ত্রী কন্যা আর ভিনদেশী রাজপুত্রের গল্প শোনার পর তরুণীরা গোলাপ পাপড়িতে ভরে দিলো আমার আসন আর তরুণরা নিয়ে এলো সুরার পাত্র। তারপর সুরার নেশায় যাপনের দোতনায় বের হয়ে এলো অনেক গল্প। ঈশ্বর কর্তৃক কুমারী ধর্ষনের গল্পটাও তারা মেনে নিলো। শুধু মেনে নিতে পারলো না ধর্মগুরু আর নগরপত্নীর গোপন প্রনয়ের গল্পটি। যারা সারা রাত ধরে আমার গল্পের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলো তারাই গল্প বলার অপরাধে আমাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলো।

শনিবার, ১১ আগস্ট, ২০১২

দ্য গেইম


সে গুণে দেখলো বড় প্যাকেটটিতে আরো ১৬৮ টি কনডম রয়ে গেছে। তাহলে গত তের মাস চব্বিশ দিনে ৭২ টি কনডম ব্যবহার হয়েছে, মনে মনে ভাবলো সে। কারণ প্যাকেটটি ছিলো বিশ ডজন আমেরিকান কনডমের। পারিবারিক স্বাস্থ্যক্লিনিক থেকে স্বাস্থ্যকর্মী মহিলাটির কাছ থেকেই সে কিনে এনেছিলো। এখনো দিব্যি মনে আছে। মহিলা বলেছিল এতোগুলো জিনিস আসলে একজনকে একসাথে দেয়া হয় না। সে কখনো মহিলার চোখের দিকে চোখ রাখেনি। মহিলা খুচরা দিতে পারছিলো না বলে আরো এক প্যাকেট দিয়ে দিবে কিনা জিজ্ঞেসও করেছিলো। কিন্তু তারপর মহিলা নিজ থেকেই বললো, মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তখন সে দেখছিলো টেবিলের কাচের নিচে জন্মনিয়ন্ত্রনের বিভিন্ন পদ্ধতির ছবি সম্বলিত কাগজটার বর্ণনা। না, সে ঠিক ছবি দেখছিলো না আর বর্ণনাও পড়ছিলো না। কিন্তু সে ও দিকেই তাকিয়ে ছিলো। আর যখন মহিলা ২০ ডজন আমেরিকান কনডমের প্যাকেটটি একটা পুরনো খবরের কাগজে মুড়িয়ে তার সামনে রেখে মহিলার নির্ধারিত আসনটিতে বসে বললো, এই নিন। তখনই সে খেয়াল করলো যে, সে খুব গভীর দৃষ্টি নিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রনের পদ্ধতিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে যদিও প্রকৃত অর্থে তার ওদিকে কোন মনোযোগই ছিলো না এবং মহিলাটি এটি টের পেয়ে গেছে ভেবে সে কিছুটা বিব্রত হয়েছিলো। হ্যাঁ, তার এই প্যাকেটটিতে এখন ১৬৮ টি কনডম অবশিষ্ট্য রয়েছে।
কনডমগুলো হাতে নিয়েই সে মনে করতে চেষ্টা করলো তার স্ত্রীর সাথে তার শেষ কথোপকথন কি ছিলো। তার মনে পড়লো, গত মাস তিনেকের শীতলতার পর সেদিন ঘুমন্ত তাকে তার স্ত্রী চুমু খেয়েছিলো। চুমুর পর সে যখন তার স্ত্রীকে ঘুমের ঘোরে আরো কাছে জড়িয়ে নিতে চাইলো তখন তার স্ত্রী অভিযোগ তুললো তার মুখে ঘুমের গন্ধ লেগে আছে। তারপর ঘুম ভেঙ্গে গেলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নির্ধারিত সময়ের পঁচিশ মিনিট পর তার ঘুম ভেঙ্গেছে। সে নিজেকে স্ত্রীর কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে স্নানঘরে ঢুকে। স্নানঘর থেকে বের হয়ে প্রতিদিনের মতো টেবিলে সাজানো সকালের রুটি আর ভাজি খেয়ে নেয়। তারপর চা খেতে খেতে শার্ট আর প্যান্টটা পড়ে নেয়। তখন তার স্ত্রী জানালা দিয়ে ওপাশে পুকুরের স্নানরত মানুষদের দেখছিলো। যাওয়ার সময় সে বলেছিলো, যাচ্ছি। এ কথা শুনে তার স্ত্রী 'আচ্ছা' বলেছিলো কি না সে মনে করতে পারলো না। যদি 'আচ্ছা' বলে থাকে তবে সেটাই ছিলো তার শেষ কথা। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে সে তার স্ত্রীকে আর বাসায় পায়নি।
স্ত্রীর সাথে এমনিতে তার সম্পর্ক খারাপ ছিলো না। মূলত সে নিজেও মানুষ খারাপ নয়। চারবছরের সংসার জীবনে স্ত্রীর সাথে তপ্ত বাক্য বিনিময় পর্যন্ত হয়নি। সে ভেবে দেখলো, তার স্ত্রীকে নিয়ে সে সুখেই ছিলো। এমনিতে সে একটু আত্মকেন্দ্রিক চাপা স্বভাবের। নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগাগুলোও স্ত্রীর সাথে শেয়ার করেনি। সে মনে করতে পারলো না, স্ত্রীর সাথে সে কি বিষয় নিয়ে কথা বলতো। তাদের যৌন সম্পর্কেও দূরত্ব তৈরি হয় সেদিন থেকে যেদিন সে আবিষ্কার করলো তার স্ত্রী মাঝ রাত্রিতে কারো সাথে ফোনসেক্স করছে। খু্ব ঘেন্না ধরে গেলো তার। সে আর তার স্ত্রীর প্রতি সেক্স অনুভব করতো না।
ফোনসেক্স না, অন্যকারো সাথে সঙ্গম করলেও তার হয়তো এতোটা ঘেন্না লাগতো না যদি তার স্ত্রী তার সাথে প্রতারনা না করতো। তার মনে হলো এটা প্রতারনা। হ্যাঁ, সেটা রুমেলই হবে হয়তো। রুমেল তার চেয়েও সুদর্শন। বয়সেও বছর চারেকের ছোট। আচরণে চমৎকার। তার সাথে রুমেলের পরিচয় করিয়ে দেয় তারই এক বন্ধু। সিনেমা পাগল রুমেলকে একদিন সে বাসায় নিয়ে আসে। তার সিনেমার সংগ্রহ ছিলো খুব। রুমেলেরও ছিলো। তাই ঘন ঘন সিনেমা দেয়া নেয়ার ব্যাপারে বাসায় আসতে শুরু করে। ঘন ঘন আসাটা প্রতিদিন আসায় রূপ নিলো। সে বুঝতে পারলো, রুমেলের ভার্চুয়াল সিনেমার চেয়ে বাস্তবিক কোন সিনেমার প্রতি আকর্ষণ রয়েছে। এবং ব্যাপারটায় সে নিজেও মজা পাচ্ছিলো। দেখা যাক বিষয়টা কোন দিকে গড়ায়- ভেবেছিলো সে।
গেইমটা সে খেলতে চেয়েছিলো রুমেলের সাথে আর খেলার উপকরণ ছিলো তার স্ত্রী। নিজের উপর প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ছিলো তার। রুমেলকে সে বেশ কিছু সুযোগও দিলো, রুমেল যেন ভাবে খেলোয়ার হিসেবে সে দুর্বল ও বোকা। কিন্তু এক সকালে রুমেল একটা ভুল চাল দিলো আর সাথে সাথেই সে ধরে বসলো রুমেলকে। বোকাচোদা রুমেলও সাথে সাথে তার পায়ের কাছে পড়ে গেলো। অনুনয় করে বলে উঠলো, 'ভাই, আমি শুধু আপনার কাছেই আসি। আমার কোন দোষ নাই। আমার মনে কোন পাপ নাই।' শালা খেলা জমার আগেই হেরে বসতে চায়! ওখানেই খেলা শেষ করতে চায়নি। আরো খেলতে চেয়েছিলো সে। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে সেজে বসেছিলো বিরাট বোকা। যেন এসবের কিছুই বোঝে না। কিন্তু কিছুদিন পরই বুঝতে পেরেছিলো আসলে সে নিজেই হেরে যাচ্ছে বল যখন গোলপোস্টে ঢুকে যায় নিজের ইচ্ছায় খেলোয়ারের দক্ষতা সেখানে অসহায়
সেই রাতে যখন সে প্রথম আবিষ্কার করে তার স্ত্রী তাকে ফাঁকি দিয়ে ফোন সেক্স করছে, প্রথমে সে বিপন্ন বোধ করে। সে বুঝে উঠতে পারে না যে তার কি করা উচিত। আর এরপর থেকে সে তার স্ত্রীর প্রতি প্রচণ্ড ঘেন্না অনুভব করে। মনে হয় তার প্রতারক স্ত্রীর শরীর জুড়ে শুয়ো পোকা আর শুয়ো পোকা। কাপড় নাড়লেই টপাটপা পড়তে থাকবে। তাকে তার ছুঁতে ইচ্ছে করতো না মোটেও। তারপর ধীরে ধীরে দূরত্বের বসবাস এবং একদিন তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে রুমেলের কাছে চলে যায়। তার স্ত্রী চলে যাওয়ার পর সে বিভ্রান্ত হয়ে যায় এই ভেবে যে গেইমটিতে তার অবস্থান কোথায়, জয়ে না পরাজয়ে? কিন্তু আজ ১৬৮ টি কনডমের প্যাকেট হাতে সে যখন স্ত্রীকে অন্যের আশ্রিতা ভেবে ভোগের কল্পনায় তখন তার শরীর প্রচণ্ড জেগে ওঠে আর নিজেকে খুব জয়ী মনে হয়। সে ১৬৭ টি কনডম বাতাসে ফুলিয়ে ঘরে ঝুলিয়ে রাখে আর অন্যটি তার শরীরে।

মঙ্গলবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১২

ছায়াদর্জির গল্প



আমাদের শহরপাড়ায় এক দর্জি ছিলেন। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। ফর্সা মুখের তুথনিতে এক গোছা শাদা দাড়ি। মাথায় শাদা গোল টুপি। শাদা লুঙ্গি আর কখনো শাদা গেঞ্জি অথবা পাঞ্জাবি পড়ে তার কুঁড়ে ঘরটার একটা অংশ দোকানের মতো খুলে নানা রঙের কাপড় নিয়ে সারাদিন আপন মনে সেলাই করতে দেখতাম। কী সব পোশাক তিনি সেলাই করতেন তা জানতাম না। একদিন বাবার লুঙ্গি সেলাই করতে নিয়ে গিয়েছিলাম তার কাছে। আমার দিকে না তাকিয়েই এক মনে লাল রঙের একটা কাপড় সেলাই করতে করতে জানালেন, তিনি লুঙ্গি সেলাই করেন না। বন্ধুদের কাছে শুনেছি তারাও কারো শার্ট, কারো ভাবীর ব্লাউজ কিংবা বোনের কামিজ সেলাই করতে নিয়ে গিয়ে ফেরত এসেছে। আমরা ভাবতাম, তাহলে সারাদিন তিনি কী সেলাই করেন এতো!


এক দুপুর শেষে খাবার জন্য ঘরে ফেরার পথে দেখি দর্জি তার ভারী কালো ফ্রেমের চশমার ভেতর দিয়ে এক দৃষ্টে সূক্ষ্মভাবে দেখে কী যেন সেলাই করছেন। ভাবলাম, গিয়ে দেখি তার সেলাইকৃত পোশাকটা কী? কিন্তু নীল একটা কাপড় ছাড়া সেটা শার্ট না পাঞ্জবী অথবা অন্য কোন পোশাক কিনা কিছুই বুঝলাম না। তিনি অকস্মাৎ সেলাই থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন আমি কী চাই। আমার পকেট থেকে ঘামমোছা শাদা রুমালটা বের করে দিয়ে বললাম, বামহাতের একটা দস্তানা বানিয়ে দিতে। তিনি মৃদু হেসে বললেন, তিনি দস্তানা বানান না। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, তবে তিনি কি বানান? তিনি গম্ভীর হয়ে বিরক্ত সহকারে আমাকে আমার কাজে যেতে বললেন। আমি বেরিয়ে এসে আমার বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে বাম হাতে রুমালে ঘাড়ের ঘাম মুছতে মুছতে মনে মনে রাগ ঝারলাম, 'বালের দর্জি হইসে! বাল সেলাই করে!'


তারপর একদিন শীতের মৌসুমে যাত্রাবালার নাচ দেখে রাত করে ঘরে ফেরার সময় দেখি ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আমার ছায়া পড়ছে না। ভাবলাম কুয়াশা আলো খেয়ে ফেলায় হয়তো আমার ছায়া দেখছি না, যদিও সে রাতে কুয়াশা ছিলো না তেমন একটা। কিন্তু ঘরে এসে টাংস্টানের হলুদ বাতিতেও দেখলাম আমার ছায়া নেই। প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে ঘুমাতে গেলাম। পরদিন সূর্য উঠতেই দৌড়ে মাঠে দাঁড়ালাম। নাহ্, কোন ছায়া নেই। কিছুতেই স্মরণ করতে পারলাম না শেষবার কখন ছায়াটাকে আমি দেখেছিলাম।


বিষয়টা রটে গেলো। আমি প্রচণ্ড বিব্রত। বাবা-মাও দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হলেন।পরিচিতরা দেখা হওয়া মাত্রই আমার ছায়া সম্পর্কে খোঁজ-খবর জিজ্ঞেস করতো। যেন আমার চেয়ে আমার ছায়ার গুরুত্ব বেশি। যদিও ছায়া থাকা আর না থাকা তেমন গুরুতর কোন বিষয় না। কিন্তু আলোতে গেলেই ছায়াহীনতা আমার বুকের মাঝে শূন্যতার সৃষ্টি করতো। খুব মন খারাপ হতো। লেজকাটা শেয়ালটার মতো বিব্রত থাকতাম সবসময়। বুঝতে পারি আমাকে দেখে লোকজন গোপনে হাসাহাসি করে। আর ব্যতিক্রম যে এই সমাজ সহজে মেনে নিতে পারে না সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।


ছায়া হারানোর কষ্ট আর লোকজনের তীর্যক মন্তব্য ও অস্বাভাবিক আচরণ আমাকে প্রচণ্ড আহত করায় মন খারাপ হতো খুব। কেউ আমাকে বোঝার চেষ্টা করতো বলে মনে হতো না আমার কাছে। তাই প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি আমাদের নদীটার উপর নির্জন রেলব্রীজটার পাশে চুপচাপ বসে থাকতাম। লক্ষ্য করলাম রেলব্রীজটার অদূরে তিনতলা একটা বাড়ির ছাদ থেকে একটা কিশোরী আমাকে চুপচাপ দেখে। আমার মনে হলো আর আর মানুষের মতো সেও আমার ছায়াহীনতা আমাকে জোকার কিংবা অদ্ভুত কোন এক প্রাণীর মতোই ধরে নিয়ে আগ্রহ থেকেই চুপচাপ আমাকে দেখার চেষ্টা করে। এক বিকেলে হাঁটতে আসার ছলে কিশোরী আমার পাশে এসে দাঁড়ায় এবং জিজ্ঞেস করে কেন শুধু শুধু আমি মন খারাপ করছি। আর এও বলে, ছায়া এমন কোন গুরুতর বিষয় নয়। আমি তাকে এই বলি যে, সে যদি তার ছায়া হারাতো তাহলে সে বুঝতে পারতো। তখন সে জানায় তার এক মামাতো ভাই যে কিনা সালমান খানের মতো দেখতে ছিলো, সে ছায়া হারিয়ে ছায়ার কষ্টে আত্মহত্যা করে। তাই সে ভয় পাচ্ছে আমিও এমন কোন কিছু করে বসি কিনা। আমি চুপচাপ ঘরে ফিরি সে দিন।


বন্ধুবান্ধব আমাকে নিয়ে বিব্রত, বিব্রত আত্মীয় স্বজনও। কোন কোন আত্মীয় স্বজন বাসায় এসে বাবা মাকে কথা শুনিয়ে যায়। আমার ছায়া আমাকে ছেড়ে যাওয়ায় তারা সমাজে মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারছে না। বাবা-মারও সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত হলে আমাকে ছায়া ছেড়ে যাওয়ার কথা বলে তিরস্কার করে। আমার খুব মন খারাপ হয়। আমিও ভাবি এই উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে আমাকে আত্মহত্যার পথই বেছে নিতে হবে। এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই।


সকালে এসে দাঁড়িয়েছি রেল ব্রীজটার কাছে এই ভেবে যে প্রথম যে ট্রেনটা আসবে সেটার নীচেই কাটা পড়ে মারা যাবো। কিছুক্ষণ পর কিশোরীটা এসে হাজির। সেদিনের পর থেকে সে প্রায়ই এসে আমার সাথে ছায়া এবং তার মামাতো ভাই সম্পর্কে কথা বলতো। তাকে আমি জানালাম আজই তার মামাতো ভাইএর মতো আমিও ছায়াহীন দেহ ত্যাগ করবো। সে বিষণ্ণ হলো। আমাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলো যে ছায়াহীনতা কোন বিষয় নয়। দূরে কোন শহরে গিয়ে একা একা বেঁচে থাকাও সম্ভব, সে একথাও বললো। শেষে সে তার নিজের ছায়াটাই আমাকে দিয়ে দিতে চাইলো। আমি জানতে চাইলাম, সে ছায়াহীন কি করে বাঁচবে এবং তার কি ছায়ার জন্য শূন্যতা অনুভূত হবে না আর তার বাবা-মা, আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধব তাকে নিয়ে বিব্রত বোধ করলে সে তা কিভাবে মোকাবেলা করবে। সে দৃঢ় কণ্ঠে জানালো এগুলো তার কাছে কোন বিষয় না। আমি তাকে আমার শঙ্কার কথা জানিয়ে দিলাম, ছায়ার অভাবে হয়তো তার বিয়েও হবে না কোনদিন! আর তাই আমি তার এতো বড়ো ক্ষতি করে তার ছায়া নিতে অস্বীকৃতি জানালাম। শেষে সে আমাকে পাঁচ বছরের জন্য ছায়াটা ধার দেয়ার কথা বললো। সে জানালো, পাঁচ বছরের আগে তার বিয়ের সম্ভাবনা নেই। তার যখন বিয়ে হবে তখন সে তার ছায়াটা আমার কাছ থেকে ফেরত নিয়ে যাবে। এ কথায় ছায়াহীন ক্লান্ত নিস্তেজ এবং বিপর্যস্ত আমি তার সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম। কিন্তু সমস্যা হলো তার দেয়া ছায়াটা আমার সাথে আসে না। সে চলার সাথে সাথে ছায়া তার সাথে চলে যায়। কিছুতেই ছায়াটাকে আমার সাথে চলাতে পারছিলাম না। সে তখন পরামর্শ দিলো, তার ছায়াটা আমার পায়ের সাথে সেলাই করে নিলে হয়তো ছায়াটা আমার সাথেই থাকবে। তবে ছায়া সেলাই করার মতো এমন সূক্ষ্ম সেলাই জানা দর্জি পাওয়া কঠিন বলেও সে জানালো। আমার তখন আমাদের পাড়ার সেই দর্জিটার কথা স্মরণ হয়। আমি কিশোরী আর তার ছায়াকে নিয়ে দর্জির কাছে যাই। দর্জি তখন কি যেন একটা সেলাই করা নিয়ে ব্যস্ত। তাঁকে গিয়ে অনুরোধ করে বললাম তিনি যেন আমার সাথে কিশোরীর ছায়াটা সেলাই করে দেন। তিনি কিছু বললেন না। আমি ভাবলাম এবারও হয়তো তিনি সেলাই করতে চাইবেন না এবং আমাদের চলে যেতে বলবেন। কিন্তু তিনি তার হাতের কাজটা রেখে উঠে গিয়ে তাকে রাখা একটা বাকশো থেকে বের করে নিয়ে আসলেন সোনামুখি সুই, চিকন সুতো আর এক টুকরা টকটকে লাল কাপড়। তারপর ভারী চশমাটা চোখে লাগিয়ে খুব নিপুন ভাবে কিশোরীর ছায়াটাকে আমার পায়ের সাথে লাল কাপড়ের জোড়া দিয়ে সেলাই করে দিলেন।