মঙ্গলবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১২

ছায়াদর্জির গল্প



আমাদের শহরপাড়ায় এক দর্জি ছিলেন। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। ফর্সা মুখের তুথনিতে এক গোছা শাদা দাড়ি। মাথায় শাদা গোল টুপি। শাদা লুঙ্গি আর কখনো শাদা গেঞ্জি অথবা পাঞ্জাবি পড়ে তার কুঁড়ে ঘরটার একটা অংশ দোকানের মতো খুলে নানা রঙের কাপড় নিয়ে সারাদিন আপন মনে সেলাই করতে দেখতাম। কী সব পোশাক তিনি সেলাই করতেন তা জানতাম না। একদিন বাবার লুঙ্গি সেলাই করতে নিয়ে গিয়েছিলাম তার কাছে। আমার দিকে না তাকিয়েই এক মনে লাল রঙের একটা কাপড় সেলাই করতে করতে জানালেন, তিনি লুঙ্গি সেলাই করেন না। বন্ধুদের কাছে শুনেছি তারাও কারো শার্ট, কারো ভাবীর ব্লাউজ কিংবা বোনের কামিজ সেলাই করতে নিয়ে গিয়ে ফেরত এসেছে। আমরা ভাবতাম, তাহলে সারাদিন তিনি কী সেলাই করেন এতো!


এক দুপুর শেষে খাবার জন্য ঘরে ফেরার পথে দেখি দর্জি তার ভারী কালো ফ্রেমের চশমার ভেতর দিয়ে এক দৃষ্টে সূক্ষ্মভাবে দেখে কী যেন সেলাই করছেন। ভাবলাম, গিয়ে দেখি তার সেলাইকৃত পোশাকটা কী? কিন্তু নীল একটা কাপড় ছাড়া সেটা শার্ট না পাঞ্জবী অথবা অন্য কোন পোশাক কিনা কিছুই বুঝলাম না। তিনি অকস্মাৎ সেলাই থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন আমি কী চাই। আমার পকেট থেকে ঘামমোছা শাদা রুমালটা বের করে দিয়ে বললাম, বামহাতের একটা দস্তানা বানিয়ে দিতে। তিনি মৃদু হেসে বললেন, তিনি দস্তানা বানান না। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, তবে তিনি কি বানান? তিনি গম্ভীর হয়ে বিরক্ত সহকারে আমাকে আমার কাজে যেতে বললেন। আমি বেরিয়ে এসে আমার বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে বাম হাতে রুমালে ঘাড়ের ঘাম মুছতে মুছতে মনে মনে রাগ ঝারলাম, 'বালের দর্জি হইসে! বাল সেলাই করে!'


তারপর একদিন শীতের মৌসুমে যাত্রাবালার নাচ দেখে রাত করে ঘরে ফেরার সময় দেখি ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আমার ছায়া পড়ছে না। ভাবলাম কুয়াশা আলো খেয়ে ফেলায় হয়তো আমার ছায়া দেখছি না, যদিও সে রাতে কুয়াশা ছিলো না তেমন একটা। কিন্তু ঘরে এসে টাংস্টানের হলুদ বাতিতেও দেখলাম আমার ছায়া নেই। প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে ঘুমাতে গেলাম। পরদিন সূর্য উঠতেই দৌড়ে মাঠে দাঁড়ালাম। নাহ্, কোন ছায়া নেই। কিছুতেই স্মরণ করতে পারলাম না শেষবার কখন ছায়াটাকে আমি দেখেছিলাম।


বিষয়টা রটে গেলো। আমি প্রচণ্ড বিব্রত। বাবা-মাও দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হলেন।পরিচিতরা দেখা হওয়া মাত্রই আমার ছায়া সম্পর্কে খোঁজ-খবর জিজ্ঞেস করতো। যেন আমার চেয়ে আমার ছায়ার গুরুত্ব বেশি। যদিও ছায়া থাকা আর না থাকা তেমন গুরুতর কোন বিষয় না। কিন্তু আলোতে গেলেই ছায়াহীনতা আমার বুকের মাঝে শূন্যতার সৃষ্টি করতো। খুব মন খারাপ হতো। লেজকাটা শেয়ালটার মতো বিব্রত থাকতাম সবসময়। বুঝতে পারি আমাকে দেখে লোকজন গোপনে হাসাহাসি করে। আর ব্যতিক্রম যে এই সমাজ সহজে মেনে নিতে পারে না সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।


ছায়া হারানোর কষ্ট আর লোকজনের তীর্যক মন্তব্য ও অস্বাভাবিক আচরণ আমাকে প্রচণ্ড আহত করায় মন খারাপ হতো খুব। কেউ আমাকে বোঝার চেষ্টা করতো বলে মনে হতো না আমার কাছে। তাই প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি আমাদের নদীটার উপর নির্জন রেলব্রীজটার পাশে চুপচাপ বসে থাকতাম। লক্ষ্য করলাম রেলব্রীজটার অদূরে তিনতলা একটা বাড়ির ছাদ থেকে একটা কিশোরী আমাকে চুপচাপ দেখে। আমার মনে হলো আর আর মানুষের মতো সেও আমার ছায়াহীনতা আমাকে জোকার কিংবা অদ্ভুত কোন এক প্রাণীর মতোই ধরে নিয়ে আগ্রহ থেকেই চুপচাপ আমাকে দেখার চেষ্টা করে। এক বিকেলে হাঁটতে আসার ছলে কিশোরী আমার পাশে এসে দাঁড়ায় এবং জিজ্ঞেস করে কেন শুধু শুধু আমি মন খারাপ করছি। আর এও বলে, ছায়া এমন কোন গুরুতর বিষয় নয়। আমি তাকে এই বলি যে, সে যদি তার ছায়া হারাতো তাহলে সে বুঝতে পারতো। তখন সে জানায় তার এক মামাতো ভাই যে কিনা সালমান খানের মতো দেখতে ছিলো, সে ছায়া হারিয়ে ছায়ার কষ্টে আত্মহত্যা করে। তাই সে ভয় পাচ্ছে আমিও এমন কোন কিছু করে বসি কিনা। আমি চুপচাপ ঘরে ফিরি সে দিন।


বন্ধুবান্ধব আমাকে নিয়ে বিব্রত, বিব্রত আত্মীয় স্বজনও। কোন কোন আত্মীয় স্বজন বাসায় এসে বাবা মাকে কথা শুনিয়ে যায়। আমার ছায়া আমাকে ছেড়ে যাওয়ায় তারা সমাজে মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারছে না। বাবা-মারও সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত হলে আমাকে ছায়া ছেড়ে যাওয়ার কথা বলে তিরস্কার করে। আমার খুব মন খারাপ হয়। আমিও ভাবি এই উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে আমাকে আত্মহত্যার পথই বেছে নিতে হবে। এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই।


সকালে এসে দাঁড়িয়েছি রেল ব্রীজটার কাছে এই ভেবে যে প্রথম যে ট্রেনটা আসবে সেটার নীচেই কাটা পড়ে মারা যাবো। কিছুক্ষণ পর কিশোরীটা এসে হাজির। সেদিনের পর থেকে সে প্রায়ই এসে আমার সাথে ছায়া এবং তার মামাতো ভাই সম্পর্কে কথা বলতো। তাকে আমি জানালাম আজই তার মামাতো ভাইএর মতো আমিও ছায়াহীন দেহ ত্যাগ করবো। সে বিষণ্ণ হলো। আমাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলো যে ছায়াহীনতা কোন বিষয় নয়। দূরে কোন শহরে গিয়ে একা একা বেঁচে থাকাও সম্ভব, সে একথাও বললো। শেষে সে তার নিজের ছায়াটাই আমাকে দিয়ে দিতে চাইলো। আমি জানতে চাইলাম, সে ছায়াহীন কি করে বাঁচবে এবং তার কি ছায়ার জন্য শূন্যতা অনুভূত হবে না আর তার বাবা-মা, আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধব তাকে নিয়ে বিব্রত বোধ করলে সে তা কিভাবে মোকাবেলা করবে। সে দৃঢ় কণ্ঠে জানালো এগুলো তার কাছে কোন বিষয় না। আমি তাকে আমার শঙ্কার কথা জানিয়ে দিলাম, ছায়ার অভাবে হয়তো তার বিয়েও হবে না কোনদিন! আর তাই আমি তার এতো বড়ো ক্ষতি করে তার ছায়া নিতে অস্বীকৃতি জানালাম। শেষে সে আমাকে পাঁচ বছরের জন্য ছায়াটা ধার দেয়ার কথা বললো। সে জানালো, পাঁচ বছরের আগে তার বিয়ের সম্ভাবনা নেই। তার যখন বিয়ে হবে তখন সে তার ছায়াটা আমার কাছ থেকে ফেরত নিয়ে যাবে। এ কথায় ছায়াহীন ক্লান্ত নিস্তেজ এবং বিপর্যস্ত আমি তার সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম। কিন্তু সমস্যা হলো তার দেয়া ছায়াটা আমার সাথে আসে না। সে চলার সাথে সাথে ছায়া তার সাথে চলে যায়। কিছুতেই ছায়াটাকে আমার সাথে চলাতে পারছিলাম না। সে তখন পরামর্শ দিলো, তার ছায়াটা আমার পায়ের সাথে সেলাই করে নিলে হয়তো ছায়াটা আমার সাথেই থাকবে। তবে ছায়া সেলাই করার মতো এমন সূক্ষ্ম সেলাই জানা দর্জি পাওয়া কঠিন বলেও সে জানালো। আমার তখন আমাদের পাড়ার সেই দর্জিটার কথা স্মরণ হয়। আমি কিশোরী আর তার ছায়াকে নিয়ে দর্জির কাছে যাই। দর্জি তখন কি যেন একটা সেলাই করা নিয়ে ব্যস্ত। তাঁকে গিয়ে অনুরোধ করে বললাম তিনি যেন আমার সাথে কিশোরীর ছায়াটা সেলাই করে দেন। তিনি কিছু বললেন না। আমি ভাবলাম এবারও হয়তো তিনি সেলাই করতে চাইবেন না এবং আমাদের চলে যেতে বলবেন। কিন্তু তিনি তার হাতের কাজটা রেখে উঠে গিয়ে তাকে রাখা একটা বাকশো থেকে বের করে নিয়ে আসলেন সোনামুখি সুই, চিকন সুতো আর এক টুকরা টকটকে লাল কাপড়। তারপর ভারী চশমাটা চোখে লাগিয়ে খুব নিপুন ভাবে কিশোরীর ছায়াটাকে আমার পায়ের সাথে লাল কাপড়ের জোড়া দিয়ে সেলাই করে দিলেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন