বড় ভাই এষৌ সেজে অন্ধ পিতা ইসহাকের
কাছ থেকে সমস্ত পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলো যাকোব। এতে এষৌ
ক্ষুব্ধ হয়ে যাকোবকে হত্যার পরিকল্পনা করে। যাকোব তা বুঝতে পেরে পালিয়ে যায়। ঠিক করে মামা লাবনের কাছে গিয়ে কিছুদিন
আত্মগোপন করবে। যেই ভাবনা, সেই কাজ। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে বেশ কিছুদিন লেগে গেলো
পূর্ব দেশে পৌঁছাতে। যাকব যখন পৌঁছালো তখন বিকালের সোনালি আলোয় সে দেখলো বিশাল
মাঠে মেষপালকেরা মেষ চড়াচ্ছে। যাকবকে দেখে তারা জানতে চাইলো, ‘পথিক কোথা থেকে আসলে
হে?’ যাকব বললো, ‘পশ্চিমের হারোন থেকে আসছি, জনাব। আচ্ছা, আপনারা কি নাহোরের পুত্র
লাবনকে চেনেন?’ ‘চিনি বৈকি!’ উত্তর করলো তাদের একজন। তারপর পূর্বের দিকে পানির
পাত্র হাতে একজন মেয়েলোককে দেখিয়ে বললো, ‘ঐ দেখো, লাবনের কন্যা আসছে।’ যাকোব দেখলো
চমৎকার এক মেয়ে, বিকালের সোনালি আলোয় তার সোনা মুখ আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বাতাসে
মেয়েটির ওড়না উড়ছে। আর ধীরে এগিয়ে আসছে যেন তার দিকেই। প্রথম দেখাতেই যাকব মেয়েটির
প্রেমে পড়ে গেলো।
মেয়েটি আসছিলো কুয়ো থেকে জল নিতে। যাকবকে পাশ কাটিয়ে কুয়োর কাছে সে চলে
গেলো। কিন্তু কুয়োর মুখটি ঢাকা ছিলো ভারী এক পাথরে, মেয়েটি ভারী পাথর সরাতে
পারছিলো না। যাকব তার পেশিবহুল হাতে ভারী পাথরটি সরিয়ে দিলো। মেয়েটি কৃতজ্ঞতা
জানালো। যাকব মেয়েটির কাছে তার নাম
জিজ্ঞেস করলো। মেয়েটি উত্তরে বললো, রাহেল। জলের পাত্র নিয়ে রাহেল তখন হাঁটছে বাড়ির
দিকে, আর যাকব তার পাশে পাশে। যাকব বললো, ‘রাহেল তোমার পিতার নাম লাবন, তিনি
নাহোরের পুত্র; তাই না?’ লাজুক ভঙিতে মাথা নাড়ালো রাহেল, হ্যাঁ। জিজ্ঞাসু চোখ
যাকবের দিকে তোলে জানতে চায়লো, ‘কিন্তু আপনি জানেন কী করে?’ ‘তুমি তোমার পিতাকে
গিয়ে বলো, তার প্রিয় ভগ্নি রিবিকার পুত্র যাকব এসেছে।’ এই বলে যাকব রাহেলের বাড়ির
সম্মুখ দিকের ছায়াদান কারী বৃক্ষের নীচে দাঁড়ালো। রাহেল বাড়ি গিয়ে বিস্তারিত খুলে
বললো তার পিতাকে। পিতা লাবন সব শুনে দৌড়ে আসলেন, বৃক্ষের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা যাকবকে
বুকে জড়ালেন, ‘পুত্র আমার, রিবিকার সন্তান, তুমি আমার বুকে আসো।’ যাকবও তার মামাকে
জড়িয়ে ধরলো গভীর আবেগে। লাবন যাকবকে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলো। আদর আপ্যায়ন করলো।
কতদূর থেকে এসেছে বোনের ছেলে! পরদিন সকাল বেলা মামাকে সব খুলে বললো যাকব: দেখেন
মামা, আপনার কাছে এসেছি মাস খানিক থাকবো বলে। বড় ভাই এষৌ খুব ক্ষেপেছে আমার উপর।
বাবাতো বড় বলে সব সম্পত্তির অধিকার দিয়ে দিচ্ছিলো এষৌকে। আর তা হলে আমি হতাম এষৌএর
দাস ছাড়া কিছুই না। কিন্তু আমার গায়ে যে শক্তি আছে, মাথায় যে বুদ্ধি আছে তা কি এষৌ-এর
আছে? মোটেই না। আমিই দাবী রাখি সব কিছুর অধিকার। তাই অন্ধ পিতার কাছে আমি এষৌ সেজে
গিয়েছিলাম আর সব কিছুর অধিকারও আমি পেয়েছি। কিন্তু এষৌ ক্ষেপেছে আমার উপর। আমাকে
খুন করে ফেলতে চাচ্ছে। মাস খানিক পর তার রাগ কমে যাবে, আমি জানি। তখন আমি ফিরে
গিয়ে আমার কর্তৃত্ব নিয়ে নেবো। এই কটা দিন মামা আপনার এখানেই থাকতে চাই।’ অমত করলো
না লাবন। যাকব থাকতে থাকলো মামার বাড়িতেই। শুয়ে বসে তো আর থাকা যায় না। আবার
রাহেলকে সে ভালোবেসেও ফেলেছে। ঠিক করেছে ফেরার সময় সে মামার কাছে রাহেলকে চেয়ে
বসবে।
যাকব এখন তার গোত্রের প্রধান নিশ্চয়ই মামা অমত
করবেন না। আর মামাকেও দেখাতে হবে সে আসলেই সেরা। এই ভেবে মামার মেষের পালের
দেখাশোনা আর যবের ক্ষেতের কাজগুলো নিজ থেকেই মন দিয়ে করতে থাকলো। লাবন দেখলো
যাকবতো বেশ কাজের ছেলে। মেষগুলো তাগরা হয়ে উঠেছে এই কদিনেই। যাকব শুধু রাহেলের
পাশাপাশি থাকে। রাহেলও বুঝতে পারছে কিছু একটা। তার মনও টানে কেবল যাকোবের দিকে।
তাকে একবার দেখলেই মনে শান্তি লাগে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে ভাবনা জুড়ে কেবল এই লোকটাই
কীভাবে যেন এসে যায়। যাইহোক, দেখতে দেখতে একমাস কেটে গেলো। যাকবের রওয়ানা দেয়ার
সময় হয়ে গেলো। যাকব মামা লাবনকে ধন্যবাদ দিলো। লাবন মনে মনে চাচ্ছিলো যাকব যেন
থেকে যায়। যে কাজের ছেলে! ও থাকলে লাবনের ভাগ্যই বদলে যাবে। মেষের পাল হবে আরো বড়,
যবের ফলন আরো বাড়ানো যাবে। যাকব যাওয়ার সময় যখন বলে বসলো যে, রাহেলকে সে ভালোবেসে
ফেলেছে। সে নিজের সাথে করে রাহেলকে নিয়ে যেতে চায়। রাহেলকে সে কখনো কষ্ট দেবে না।
রাখবে রাজরানী করে। রাহেল অদূরেই ছিলো, শুনে যদিও মুখ ঢাকলো, কিন্তু ভেতরে ভেতরে
বয়ে গেলো খুশির বন্যা। লাবন খুব বুদ্ধিমান ও চতুর। এই ব্যাপারটাকে সে কাজে লাগাতে
চায়লো। বললো, দেখো বাবা, রাহেলকে তুমি ভালোবাসো। তুমিও রাহেলের উপযুক্ত। আর তুমি
বোনের ছেলে, তোমার হাতে রাহেলকে তোলে দিতে পারলে আমিও খুশি হই। কিন্তু এর জন্যতো
তোমাকে আমার এখানে সাত বছর থাকতে হবে। আমি যে পণ করেছি আমার মেয়েদের পাত্রস্ত করার
আগে তাকে অবশ্যই আমার এখানে সাত বছর থাকতে হবে, আমার হয়ে কাজ করতে হবে। যাকব তখন
প্রেমে উন্মুত্ত। ভালোবাসার জন্য সে সব কিছুই করতে পারে। থেকে গেলো লাবনের
কাছে। লাবনের ছিলো দুই মেয়ে। বড় মেয়ে লিহা
আর ছোট মেয়ে রাহেল।
দেখতে দেখতে সাত বছর কেটে গেলো। যাকব তার মামার কাছে গিয়ে জানালো তার
প্রতিশ্রুতির কথা। লাবনও বললো, ‘মনে আছে, বাছা।’
বিয়ের দিন ধার্য্য হলো। ধুমধাম করে বিয়ে হলো। যাকবতো মহাখুশি প্রাণের
প্রিয়া রাহেল হতে যাচ্ছে তার। ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার চেয়ে পৃথিবীতে সুখের আর কি
আছে!
কিন্তু বিয়ের পরদিন ভোরে ঘুম ভেঙ্গে দেখে বিছানায় তার পাশে যে শুয়ে আছে সে
তো রাহেল নয়, লিহা।
রেওয়াজ অনুযায়ী বিয়ের কন্যার মুখ ছিলো পর্দায় ঢাকা। আর বিয়ের প্রথম রাতে বর
কনের মুখ দেখতে পারে না। কারণ অন্ধকার ঘরে তাদের থাকতে দেয়া হয়।
ক্ষোভে ফেটে পড়ে যাকব। বৃথা মনে হয় তার জীবন। সে তার মামা লাবনকে জিজ্ঞেস
করে, কেন সে তার সাথে এমন করলো? রাহেলকে ভালোবেসে কি সে অপরাধ করেছে? লাবনের কথা
মতোই কি সে সাত বছর খেটে যায় নি? তবে কেন সে এমন করলো?
চতুর লাবন হাসলো। বললো, ‘বাছা! আমি কি না করেছি কখনো রাহেলকে তোমার সাথে
বিয়ে দেবো না? এতো সৌভাগ্য যে তুমি রাহেলকে বিয়ে করতে চাও। কিন্তু বাপধন তোমাকে
বুঝতে হবে, লিহা হচ্ছে বড়। আগে লিহার বিয়ে হওয়া দরকার। এটাই নিয়ম। রাহেলকে তুমি
বিয়ে করতে চায়লে আমার আপত্তি নাই কোন। তুমি আরো সাত বছর কাজ করার প্রতিশ্রুতি দাও।
তাহলে আমি রাহেলকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে পারি, বুঝোইতো পণ করেছি সাত বছর আমার সাথে
কাজ না করলে মেয়েকে আমি বিয়ে দেবো না....’
অগত্যা আর কি করা! ভালোবাসার জন্য, রাহেলের জন্য যাকব আরো সাত বছর খেটে
গেলো লাবনের হয়ে। শেষে রেহালের সাথে যাকবের বিয়ে হয়। লিহা ও রেহালের গর্ভে জন্ম
নেয় যাকবের বারো পুত্র। আর রেহাল যাকবের সন্তান জন্মদিতে গিয়ে মারা যায়। সেই গল্প
আর দিন করা যাবে। যাকব রাহেলের জন্য চৌদ্দ বছর খেটেছে, অপেক্ষা করেছে। এই
প্রতীক্ষাই যাকবকে প্রেমিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। আর একটা বলা দরকার। ‘যাকব’কে
ডাকা হতো ‘ইস্রাইল’ নামেও। সেই থেকেই বনীইসরাইল। মানে যাকবের ১২ পুত্র থেকেই আসে
বনী ইসরাইলের বারো গোত্র।
এষৌ'র কী কোনো ডাকনাম ছিলো?
উত্তরমুছুনতার সম্পর্কে আর জানা যায় না?
এষৌ'কে কী নামে ডাকা হতো?
উত্তরমুছুনইসহাক
উত্তরমুছুন