বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৪

বাইবেলের প্রেমের গল্প: যাকোব ও রাহেল


 বড় ভাই এষৌ সেজে অন্ধ পিতা ইসহাকের কাছ থেকে সমস্ত পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলো যাকোব। এতে এষৌ ক্ষুব্ধ হয়ে যাকোবকে হত্যার পরিকল্পনা করে। যাকোব তা বুঝতে পেরে পালিয়ে যায়।   ঠিক করে মামা লাবনের কাছে গিয়ে কিছুদিন আত্মগোপন করবে। যেই ভাবনা, সেই কাজ। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে বেশ কিছুদিন লেগে গেলো পূর্ব দেশে পৌঁছাতে। যাকব যখন পৌঁছালো তখন বিকালের সোনালি আলোয় সে দেখলো বিশাল মাঠে মেষপালকেরা মেষ চড়াচ্ছে। যাকবকে দেখে তারা জানতে চাইলো, ‘পথিক কোথা থেকে আসলে হে?’ যাকব বললো, ‘পশ্চিমের হারোন থেকে আসছি, জনাব। আচ্ছা, আপনারা কি নাহোরের পুত্র লাবনকে চেনেন?’ ‘চিনি বৈকি!’ উত্তর করলো তাদের একজন। তারপর পূর্বের দিকে পানির পাত্র হাতে একজন মেয়েলোককে দেখিয়ে বললো, ‘ঐ দেখো, লাবনের কন্যা আসছে।’ যাকোব দেখলো চমৎকার এক মেয়ে, বিকালের সোনালি আলোয় তার সোনা মুখ আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বাতাসে মেয়েটির ওড়না উড়ছে। আর ধীরে এগিয়ে আসছে যেন তার দিকেই। প্রথম দেখাতেই যাকব মেয়েটির প্রেমে পড়ে গেলো।
মেয়েটি আসছিলো কুয়ো থেকে জল নিতে। যাকবকে পাশ কাটিয়ে কুয়োর কাছে সে চলে গেলো। কিন্তু কুয়োর মুখটি ঢাকা ছিলো ভারী এক পাথরে, মেয়েটি ভারী পাথর সরাতে পারছিলো না। যাকব তার পেশিবহুল হাতে ভারী পাথরটি সরিয়ে দিলো। মেয়েটি কৃতজ্ঞতা জানালো। যাকব মেয়েটির কাছে  তার নাম জিজ্ঞেস করলো। মেয়েটি উত্তরে বললো, রাহেল। জলের পাত্র নিয়ে রাহেল তখন হাঁটছে বাড়ির দিকে, আর যাকব তার পাশে পাশে। যাকব বললো, ‘রাহেল তোমার পিতার নাম লাবন, তিনি নাহোরের পুত্র; তাই না?’ লাজুক ভঙিতে মাথা নাড়ালো রাহেল, হ্যাঁ। জিজ্ঞাসু চোখ যাকবের দিকে তোলে জানতে চায়লো, ‘কিন্তু আপনি জানেন কী করে?’ ‘তুমি তোমার পিতাকে গিয়ে বলো, তার প্রিয় ভগ্নি রিবিকার পুত্র যাকব এসেছে।’ এই বলে যাকব রাহেলের বাড়ির সম্মুখ দিকের ছায়াদান কারী বৃক্ষের নীচে দাঁড়ালো। রাহেল বাড়ি গিয়ে বিস্তারিত খুলে বললো তার পিতাকে। পিতা লাবন সব শুনে দৌড়ে আসলেন, বৃক্ষের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা যাকবকে বুকে জড়ালেন, ‘পুত্র আমার, রিবিকার সন্তান, তুমি আমার বুকে আসো।’ যাকবও তার মামাকে জড়িয়ে ধরলো গভীর আবেগে। লাবন যাকবকে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলো। আদর আপ্যায়ন করলো। কতদূর থেকে এসেছে বোনের ছেলে! পরদিন সকাল বেলা মামাকে সব খুলে বললো যাকব: দেখেন মামা, আপনার কাছে এসেছি মাস খানিক থাকবো বলে। বড় ভাই এষৌ খুব ক্ষেপেছে আমার উপর। বাবাতো বড় বলে সব সম্পত্তির অধিকার দিয়ে দিচ্ছিলো এষৌকে। আর তা হলে আমি হতাম এষৌএর দাস ছাড়া কিছুই না। কিন্তু আমার গায়ে যে শক্তি আছে, মাথায় যে বুদ্ধি আছে তা কি এষৌ-এর আছে? মোটেই না। আমিই দাবী রাখি সব কিছুর অধিকার। তাই অন্ধ পিতার কাছে আমি এষৌ সেজে গিয়েছিলাম আর সব কিছুর অধিকারও আমি পেয়েছি। কিন্তু এষৌ ক্ষেপেছে আমার উপর। আমাকে খুন করে ফেলতে চাচ্ছে। মাস খানিক পর তার রাগ কমে যাবে, আমি জানি। তখন আমি ফিরে গিয়ে আমার কর্তৃত্ব নিয়ে নেবো। এই কটা দিন মামা আপনার এখানেই থাকতে চাই।’ অমত করলো না লাবন। যাকব থাকতে থাকলো মামার বাড়িতেই। শুয়ে বসে তো আর থাকা যায় না। আবার রাহেলকে সে ভালোবেসেও ফেলেছে। ঠিক করেছে ফেরার সময় সে মামার কাছে রাহেলকে চেয়ে বসবে।
যাকব এখন তার গোত্রের প্রধান নিশ্চয়ই মামা অমত করবেন না। আর মামাকেও দেখাতে হবে সে আসলেই সেরা। এই ভেবে মামার মেষের পালের দেখাশোনা আর যবের ক্ষেতের কাজগুলো নিজ থেকেই মন দিয়ে করতে থাকলো। লাবন দেখলো যাকবতো বেশ কাজের ছেলে। মেষগুলো তাগরা হয়ে উঠেছে এই কদিনেই। যাকব শুধু রাহেলের পাশাপাশি থাকে। রাহেলও বুঝতে পারছে কিছু একটা। তার মনও টানে কেবল যাকোবের দিকে। তাকে একবার দেখলেই মনে শান্তি লাগে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে ভাবনা জুড়ে কেবল এই লোকটাই কীভাবে যেন এসে যায়। যাইহোক, দেখতে দেখতে একমাস কেটে গেলো। যাকবের রওয়ানা দেয়ার সময় হয়ে গেলো। যাকব মামা লাবনকে ধন্যবাদ দিলো। লাবন মনে মনে চাচ্ছিলো যাকব যেন থেকে যায়। যে কাজের ছেলে! ও থাকলে লাবনের ভাগ্যই বদলে যাবে। মেষের পাল হবে আরো বড়, যবের ফলন আরো বাড়ানো যাবে। যাকব যাওয়ার সময় যখন বলে বসলো যে, রাহেলকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। সে নিজের সাথে করে রাহেলকে নিয়ে যেতে চায়। রাহেলকে সে কখনো কষ্ট দেবে না। রাখবে রাজরানী করে। রাহেল অদূরেই ছিলো, শুনে যদিও মুখ ঢাকলো, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বয়ে গেলো খুশির বন্যা। লাবন খুব বুদ্ধিমান ও চতুর। এই ব্যাপারটাকে সে কাজে লাগাতে চায়লো। বললো, দেখো বাবা, রাহেলকে তুমি ভালোবাসো। তুমিও রাহেলের উপযুক্ত। আর তুমি বোনের ছেলে, তোমার হাতে রাহেলকে তোলে দিতে পারলে আমিও খুশি হই। কিন্তু এর জন্যতো তোমাকে আমার এখানে সাত বছর থাকতে হবে। আমি যে পণ করেছি আমার মেয়েদের পাত্রস্ত করার আগে তাকে অবশ্যই আমার এখানে সাত বছর থাকতে হবে, আমার হয়ে কাজ করতে হবে। যাকব তখন প্রেমে উন্মুত্ত। ভালোবাসার জন্য সে সব কিছুই করতে পারে। থেকে গেলো লাবনের কাছে।  লাবনের ছিলো দুই মেয়ে। বড় মেয়ে লিহা আর ছোট মেয়ে রাহেল।

দেখতে দেখতে সাত বছর কেটে গেলো। যাকব তার মামার কাছে গিয়ে জানালো তার প্রতিশ্রুতির কথা। লাবনও বললো, ‘মনে আছে, বাছা।’  বিয়ের দিন ধার্য্য হলো। ধুমধাম করে বিয়ে হলো। যাকবতো মহাখুশি প্রাণের প্রিয়া রাহেল হতে যাচ্ছে তার। ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার চেয়ে পৃথিবীতে সুখের আর কি আছে!
কিন্তু বিয়ের পরদিন ভোরে ঘুম ভেঙ্গে দেখে বিছানায় তার পাশে যে শুয়ে আছে সে তো রাহেল নয়, লিহা।
রেওয়াজ অনুযায়ী বিয়ের কন্যার মুখ ছিলো পর্দায় ঢাকা। আর বিয়ের প্রথম রাতে বর কনের মুখ দেখতে পারে না। কারণ অন্ধকার ঘরে তাদের থাকতে দেয়া হয়।

ক্ষোভে ফেটে পড়ে যাকব। বৃথা মনে হয় তার জীবন। সে তার মামা লাবনকে জিজ্ঞেস করে, কেন সে তার সাথে এমন করলো? রাহেলকে ভালোবেসে কি সে অপরাধ করেছে? লাবনের কথা মতোই কি সে সাত বছর খেটে যায় নি? তবে কেন সে এমন করলো?
চতুর লাবন হাসলো। বললো, ‘বাছা! আমি কি না করেছি কখনো রাহেলকে তোমার সাথে বিয়ে দেবো না? এতো সৌভাগ্য যে তুমি রাহেলকে বিয়ে করতে চাও। কিন্তু বাপধন তোমাকে বুঝতে হবে, লিহা হচ্ছে বড়। আগে লিহার বিয়ে হওয়া দরকার। এটাই নিয়ম। রাহেলকে তুমি বিয়ে করতে চায়লে আমার আপত্তি নাই কোন। তুমি আরো সাত বছর কাজ করার প্রতিশ্রুতি দাও। তাহলে আমি রাহেলকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে পারি, বুঝোইতো পণ করেছি সাত বছর আমার সাথে কাজ না করলে মেয়েকে আমি বিয়ে দেবো না....’


অগত্যা আর কি করা! ভালোবাসার জন্য, রাহেলের জন্য যাকব আরো সাত বছর খেটে গেলো লাবনের হয়ে। শেষে রেহালের সাথে যাকবের বিয়ে হয়। লিহা ও রেহালের গর্ভে জন্ম নেয় যাকবের বারো পুত্র। আর রেহাল যাকবের সন্তান জন্মদিতে গিয়ে মারা যায়। সেই গল্প আর দিন করা যাবে। যাকব রাহেলের জন্য চৌদ্দ বছর খেটেছে, অপেক্ষা করেছে। এই প্রতীক্ষাই যাকবকে প্রেমিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। আর একটা বলা দরকার। ‘যাকব’কে ডাকা হতো ‘ইস্রাইল’ নামেও। সেই থেকেই বনীইসরাইল। মানে যাকবের ১২ পুত্র থেকেই আসে বনী ইসরাইলের বারো গোত্র। 

শনিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩

অন্ধ চড়াই পাখির ডানার উষ্ণ ঘ্রাণ


চাঘরের চায়ের দাগে ভরা কালচে টেবিলটিতে দুই হাতের কুনুই রেখে তালু দিয়ে ঘষে ঘষে দূর করছিলাম নাক-মুখের ক্লান্তি। কম্পিউটার অপারেটরদের কম্পিউটারের মনিটরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা ক্লান্তিকরই বটে। পাশেই বসে ছিলো মোটা চশমা চোখে শাদাদাড়িগোঁফের এক বৃদ্ধ আর তার পাশে ছয়-সাত বছরের একটি বালকশিশু। বৃদ্ধটি চু চু শব্দ করে নিজের ভেতরে ঢেলে নিচ্ছিলেন গাভীর দুধে তৈরি গরম চা। আর শিশুটি একটি বড় টোস্ট বিস্কুট চায়ের কাপে ডুবিয়ে ডুবিয়ে খাচ্ছিলো। শিশুটি যখন বৃদ্ধজনকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা দাদা, অন্ধ চড়াই পাখির বাচ্চার ডানায় কেন উষ্ণ ঘ্রাণ থাকে? তখনই আমি তাদের লক্ষ্য করি। শিশুটির মুখ দেখি। দাঁতপড়া খালি মাড়ির বৃদ্ধটির হা হা করে হাসি শুনি। আর আমার মনে পড়ে যায় আমিনুলের কথা।

বাবার চাকরি তখন ঈশ্বরগঞ্জে। নতুন স্কুলে ভর্তি হয়ে তৃতীয় শ্রেণির ক্লাসে গিয়ে বসার জায়গা পেলাম সবার শেষের বেঞ্চে। ঐ বেঞ্চে আগেই বসে থাকা ছেলেটি জানালা দিয়ে ওপাশে পুকুরে একদল হাঁসের মাছ খাওয়ার দৃশ্য দেখছিল একদৃষ্টে, আমার দিকে তাকালো না। প্রথমে এক স্যার এসে রোল ডেকে ক্লাস শুরু করলেন, বাংলা।  আমি যে নতুন এসেছি, আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন নি। ক্লাসের কেউ আমার প্রতি আগ্রহও দেখায় নি। দ্বিতীয় ক্লাস গণিত। স্যার আসার আগে থেকেই সবাই শান্ত হয়ে বসে থাকলো। পিনপতন নিরবতা। ক্লাসে ঢুকলেন কুচকুচে কালো এক স্যার, পড়নে ধবধবে শাদা পাজামা পাঞ্জাবি। হাতে সরু বেত। এসেই বেত দিয়ে টেবিলে দুইটা বাড়ি দিয়ে শব্দ করে বললেন বাড়ির কাজের খাতা বের করার জন্য। ছেলেরা বাড়ির কাজের খাতা বের করে নিজ নিজ বেঞ্চে রাখলে তিনি হেঁটে হেঁটে সবার খাতা চেক করছিলেন। যারা আনেনি তাদের আচ্ছামতো বেত দিয়ে পেটাচ্ছিলেন। যারা বাড়িরকাজ এনেছে তারা মিটমিট করে নীরব হাসি হাসছিলো মারের দৃশ্য দেখে। আমার পাশের ছেলেটি বাড়ির কাজ আনে নি। তাই সেও মার খেলো। আমারও বাড়ির কাজ নেই, আমি ক্লাসে নতুন। এই কথা স্যারকে বলা প্রয়োজন। কিন্তু স্যারের ভয়ানক মূর্তি দেখে কোন কথাই মুখ থেকে বের হচ্ছিলো না। স্যার বেত উঠালেন আমাকে মারার জন্য। তখন পাশের ছেলেটি তার মার খাওয়া পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে স্যারকে জানালো, 'স্যার, হে নতুন আইছে'। ফলে আমি সম্ভাব্য মারের হাত থেকে বেঁচে যাই। স্যারের বেত নেমে গেলো। ক্লাসের সবাই আমার দিকে তাকালো। স্যার বিমর্ষ মুখে চিকন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন- তোর নাম কি?

আমার বাসা ছিলো স্কুলের পাশেই কাঁচামাটিয়া নদীর তীরে। টিফিনে বাসায় এসে খেয়ে পুনরায় স্কুলে গিয়ে ছেলেটির পাশে গিয়ে বসলে, এই প্রথম ছেলেটি আমার কাছে জানতে চায়, অন্ধ চড়াই পাখির ছানার গাঁয়ে উষ্ণ ঘ্রাণ থাকে কিনা। আমি প্রথমে বুঝতে পারি না তার কথা। তারপর সে জানায় তাদের বাড়িতে একটা চড়াই পাখির বাসা আছে, সেখানে দুটি বাচ্চা চড়াই আছে। তাদের মা গতরাতে বাসায় ফিরে নি। গত রাত থেকে বাচ্চা দুটি টুই টুই করে কেঁদেছে। আজ সকালে সে চড়াইয়ের বাচ্চাদুটিকে ভাত খেতে দিয়েছিলো, খায় নি। কিন্তু বাচ্চাদুটির গা থেকে কেমন এক গরম গরম ঘ্রাণ সে পায়। এরপর সে জানালা দিয়ে পুকুরের পাড়ে এক কঞ্চিতে বসা একটা মাছরাঙ্গার দিকে তাকিয়ে থাকে, কথা বলে না আর। তার নাম জানতে চায়লে সে উত্তর দেয় না। ক্লাস শুরু হয়ে যায়। ক্লাস শেষ হয়। আবার ক্লাস শুরু হয়। আবার শেষ হয়। এবং এক সময় ছুটির ঘন্টা বাজে। বাসায় ফেরার সময় পেছন দিক থেকে সে আমার নাম ধরে ডাকে। আর বলে, 'আমি নুল'। তারপর চলে যায়। আমি প্রথমে ভাবি- নুল কী জিনিস! পরে বুঝতে পারি তার নাম আমিনুল।
আমিনুল ক্লাসের সব চেয়ে অমনোযোগী। কোন ক্লাসেই সে ভালো ভাবে পড়া বলতে পারে না। আর কারো পিঠে পড়ুক বা না পড়ুক গণিত স্যারের বেত তার পিঠে পড়বেই। কেউ তার সাথে খুব একটা কথাবার্তা বলে না, সেও কারো সাথে যায় না। যেহেতু প্রথম দিন সে আমাকে গণিত স্যারের নির্ঘাত মারের হাত থেকে বাঁচিয়েছে তাই তার প্রতি আমার একটা মায়া জন্ম নেয়। প্রথম দিন আমাকে মারের হাত থেকে বাঁচানোর কৃতজ্ঞতা থেকেই বোধ হয় মনে মনে তাকে বন্ধু করে নিয়েছিলাম। বাবা এক সকালে পাড়ার মসজিদে নিয়ে গেলেন হুজুরের কাছে কুরআন শেখার জন্য। গিয়ে দেখি সেখানেও আমিনুল। আমিনুল ও অন্য ছেলেমেয়েরা সিফারায় আর আমি কায়দা দিয়ে কুরআন পাঠ শিখতে থাকলাম।

একদিন টিফিনের সময় বাসায় এসে খেয়ে-দেয়ে বের হয়ে দেখি আমিনুল আমাদের বাসার সামনে নদীর তীরে কী যেন করছে। কাছে গিয়ে দেখি একটা বাঁশের কঞ্চি সে মাটিতে গিঁথে রাখছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে সে প্রতিদিন নদীর পানি কতোটুকু বাড়ছে তা মেপে রাখছে। মাটিতে গাঁথা কঞ্চিটি দেখিয়ে বললো, 'কাইল দেইখো এইটা ডুইবা যাইবো'। তখন বর্ষাকাল। নদীর পানি বাড়ছিলো।আমরা প্রতিদিন খুঁটি গেঁড়ে পানি মেপে আসতাম। এক বৃহস্পতিবার দুপুরে স্কুল ছুটি হয়ে গেলে নদীর পানি মাপার পর মা বললেন আমিনুল যেন খেয়ে যায়। তো তাকে নিয়ে খেতে বসলাম। মা ডিম ভুনা আর শিং মাছের তরকারি দিয়ে খেতে দিলেন। তাকে আস্ত একটা ডিম খেতে দেয়া হলে ইতস্তত করে সে খেলো।
খাওয়ার পর নদীর তীরে আমরা যখন এসে দাঁড়ালাম তখন সে আমাকে জানালো জীবনের প্রথম সে আস্ত একটা ডিম খেয়েছে। এবং আমাকে বললো সে তার নানা বাড়ি থেকে একটা রাজহাঁসের বাচ্চা এনেছে। রাজহাঁসটা বড় হয়ে যখন ডিম দেবে তখন একদিন তাদের বাড়িতে রাজহাঁসের আস্ত একটা ডিম দিয়ে দাওয়াত খাওয়াবে । হাত দিয়ে সে রাজহাঁসের ডিমের আকারটাও দেখালো।
দু'জনে অনেকক্ষণ ঘুরলাম। সে আমাকে সোনালি টকিজ নামের সিনেমা হলের এক লোকের কাছ থেকে বিক্রিত টিকেটের মুড়ি দিয়ে বললো- এইটা দিয়া টাকার বান্ডেল বানায়া খেইলো। পাটবাজার, দুধমল, ব্রীজ ঘুরে বাড়ি ফেরার সময় সে বললো কেউ যদি কুরআন ছুঁয়ে শপথ করতে বলে তবে আমি যেন সেটা জীবনেও না করি।

একদিন মসজিদে কুরআন শেখার পাঠ শেষে চলে আসার সময় হুজুর আমাকে ডেকে নদীর কাছে নিয়ে গেলেন। জানতে চায়লেন আমি প্রতিদিন কেন সিনেমা হলের পোস্টার দেখতে যাই। আমি অবাক হলাম। ভয়ও। হুজুর হয়তো বকবেন ভেবে। আমি জানতে চাইলাম তিনি আমাকে কি করে দেখলেন, আমিতো তাঁকে দেখি নাই। হুজুর হেসে জানালেন কুরআনে একটা সুরা আছে, যা শুদ্ধভাবে তিনবার পাঠ করে অদৃশ্য হতে চায়লে অদৃশ্য হওয়া যায়। আমি বিস্মিত হলে আর কাউকে না জানিয়ে বিকেলে আছরের নামাজের পর তার ঘরে গেলে তিনি আমাকে কীভাবে অদৃশ্য হওয়া যায় দেখিয়ে দেবেন বলে জানালেন। আমি বিকেলে তার কাছে যাবো কথা দিলাম এবং এও কসম করলাম বিষয়টা কাউকে জানাবো না। কিন্তু স্কুলে এসে কথাটা আমিনুলকে না জানানো পর্যন্ত কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। তাই টিফিনের সময় আমিনুলকে হুজুরের কথাটা বলেই দিলাম। আমিনুল খুব দুঃশ্চিন্তা গ্রস্ত হয়ে পড়লো বলে মনে হলো। সে আমাকে খুব করে মানা করলো আমি যেন হুজুরের ওখানে কিছুতেই না যাই। স্কুল ছুটির সময় সে আমার পেছন পেছন পুকুর পাড়ে এসে বললো, 'হুজুরের কাছে যাইও না কিন্তু‍!' তারপর চলে গেলো। আমি বাসায় এসে হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় শুয়ে আছরের অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে জেগে দেখি মাগরিবের আযান পড়ে গেছে। 
পরদিন সকালে মা মানা করলেন হুজুরের কাছে কুরআন শিখতে যেতে হবে না। কিন্তু আমার যাওয়া জরুরী ছিলো, হুজুর হয়তো রাগ করেছেন! শেষে মা রেগে জানালেন, হুজুরকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। স্কুলে গিয়ে জানতে পারলাম আছরের পর হুজুর আমিনুলকে নির্যাতন করেছে। আমিনুল চিৎকার শুরু করলে আশেপাশের লোক এসে তাকে রক্ষা করে আর হুজুরকে মার দিয়ে পুলিশে দেয়।

আমিনুল সুস্থ হয়ে স্কুলে আসা শুরু করে। কিন্তু ক্লাসের ছেলেরা তাকে 'অসতী' বলে ক্ষেপানোর চেষ্টা করতো। কিন্তু আমিনুল শুধু আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো, আর কিছু বলতো না। আমিও বিব্রত বোধ করে তার পাশে বসা ছেড়ে দিলাম। এরপর একদিন আমিনুল স্কুলে আসা বন্ধ করে দিলো। আমি আর তাকে খুঁজে পাই নাই। 

শুক্রবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩

আত্মহত্যা

অন্ধকার গলিটাতে ঢুকতেই আধো আলোয় চোখে পড়লো লোক দুটিকে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। আমি ভয়গ্রস্তের মতো প্যান্টের ডান পকেটটা ডান হাতে চেপে ধরে দ্রুত তাদের অতিক্রম করতে চাচ্ছিলাম। একজন বললো- 'এই যে শুনেন!' পথ আগলে দাঁড়ালো। আমি ডান পকেটটা আরো শক্ত করে ধরে জানিয়ে দিলাম আমার কাছে কিছু নেই। দ্বিতীয় জন জানতে চায়লো আমার পকেটে কী। আমি কাতর কণ্ঠে আবেদন জানালাম, 'এই লাখ খানেক টাকাই আমার শেষ সম্বল, প্লিজ নেবেন না।' অন্ধকারে তাদের মুখ স্পষ্ট দেখা যায় না। একজন এসে পেছন থেকে জাবরে ধরলো। সুবিধা করতে পারলো না। অন্যজন হয়তো একটা ছুরি-টুরি বের করেছে। আমি আমার সিনাটা টান টান করে দেখিয়ে বললাম, 'এই খানে প্রাণ থাকতে কেউ আমার পকেটে হাত দিতে পারবে না।' পেছনের জন সমস্ত শক্তি দিয়ে আমাকে টেনে ধরলো আর সামনের জন বুকে বিঁধিয়ে দিলো ছুরিটা।

আমার পকেটে খামের ভেতর টাকার পরিবর্তে চিঠি ও আর আর কাগজ দেখে নিশ্চয়ই মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিলো ছেলে দুটোর।

রবিবার, ১২ আগস্ট, ২০১২

দণ্ডিত মৃত্যুর দিকে

  চমৎকার সব গল্প বলে জমিয়ে তুলছিলাম আসর। রাজকন্যা আর রাজপুত্রের গল্প শুনিয়ে প্রচণ্ড বাহবা পেলাম। ঘুঘু পাখি আর নীল তিমির গল্পেও তাদের প্রীত দেখি। আমিও উচ্ছ্বসিত হয়ে আমার ঝোলা থেকে একের পর এক গল্প বের করে ছুড়ে দিতে লাগলাম শ্রোতাদের দিকে বিস্ময়কর জাদুকরের মতো। দুঃখিনী রাজকন্যার গল্প শুনে কেঁদে বুক ভাসালো রমনীকুল। দয়ালু রাজার গল্প শোনার পর নগরপতি আমার দিকে ছুড়ে দিলো স্বর্ণমুদ্রা। মন্ত্রী কন্যা আর ভিনদেশী রাজপুত্রের গল্প শোনার পর তরুণীরা গোলাপ পাপড়িতে ভরে দিলো আমার আসন আর তরুণরা নিয়ে এলো সুরার পাত্র। তারপর সুরার নেশায় যাপনের দোতনায় বের হয়ে এলো অনেক গল্প। ঈশ্বর কর্তৃক কুমারী ধর্ষনের গল্পটাও তারা মেনে নিলো। শুধু মেনে নিতে পারলো না ধর্মগুরু আর নগরপত্নীর গোপন প্রনয়ের গল্পটি। যারা সারা রাত ধরে আমার গল্পের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলো তারাই গল্প বলার অপরাধে আমাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলো।

শনিবার, ১১ আগস্ট, ২০১২

দ্য গেইম


সে গুণে দেখলো বড় প্যাকেটটিতে আরো ১৬৮ টি কনডম রয়ে গেছে। তাহলে গত তের মাস চব্বিশ দিনে ৭২ টি কনডম ব্যবহার হয়েছে, মনে মনে ভাবলো সে। কারণ প্যাকেটটি ছিলো বিশ ডজন আমেরিকান কনডমের। পারিবারিক স্বাস্থ্যক্লিনিক থেকে স্বাস্থ্যকর্মী মহিলাটির কাছ থেকেই সে কিনে এনেছিলো। এখনো দিব্যি মনে আছে। মহিলা বলেছিল এতোগুলো জিনিস আসলে একজনকে একসাথে দেয়া হয় না। সে কখনো মহিলার চোখের দিকে চোখ রাখেনি। মহিলা খুচরা দিতে পারছিলো না বলে আরো এক প্যাকেট দিয়ে দিবে কিনা জিজ্ঞেসও করেছিলো। কিন্তু তারপর মহিলা নিজ থেকেই বললো, মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তখন সে দেখছিলো টেবিলের কাচের নিচে জন্মনিয়ন্ত্রনের বিভিন্ন পদ্ধতির ছবি সম্বলিত কাগজটার বর্ণনা। না, সে ঠিক ছবি দেখছিলো না আর বর্ণনাও পড়ছিলো না। কিন্তু সে ও দিকেই তাকিয়ে ছিলো। আর যখন মহিলা ২০ ডজন আমেরিকান কনডমের প্যাকেটটি একটা পুরনো খবরের কাগজে মুড়িয়ে তার সামনে রেখে মহিলার নির্ধারিত আসনটিতে বসে বললো, এই নিন। তখনই সে খেয়াল করলো যে, সে খুব গভীর দৃষ্টি নিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রনের পদ্ধতিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে যদিও প্রকৃত অর্থে তার ওদিকে কোন মনোযোগই ছিলো না এবং মহিলাটি এটি টের পেয়ে গেছে ভেবে সে কিছুটা বিব্রত হয়েছিলো। হ্যাঁ, তার এই প্যাকেটটিতে এখন ১৬৮ টি কনডম অবশিষ্ট্য রয়েছে।
কনডমগুলো হাতে নিয়েই সে মনে করতে চেষ্টা করলো তার স্ত্রীর সাথে তার শেষ কথোপকথন কি ছিলো। তার মনে পড়লো, গত মাস তিনেকের শীতলতার পর সেদিন ঘুমন্ত তাকে তার স্ত্রী চুমু খেয়েছিলো। চুমুর পর সে যখন তার স্ত্রীকে ঘুমের ঘোরে আরো কাছে জড়িয়ে নিতে চাইলো তখন তার স্ত্রী অভিযোগ তুললো তার মুখে ঘুমের গন্ধ লেগে আছে। তারপর ঘুম ভেঙ্গে গেলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নির্ধারিত সময়ের পঁচিশ মিনিট পর তার ঘুম ভেঙ্গেছে। সে নিজেকে স্ত্রীর কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে স্নানঘরে ঢুকে। স্নানঘর থেকে বের হয়ে প্রতিদিনের মতো টেবিলে সাজানো সকালের রুটি আর ভাজি খেয়ে নেয়। তারপর চা খেতে খেতে শার্ট আর প্যান্টটা পড়ে নেয়। তখন তার স্ত্রী জানালা দিয়ে ওপাশে পুকুরের স্নানরত মানুষদের দেখছিলো। যাওয়ার সময় সে বলেছিলো, যাচ্ছি। এ কথা শুনে তার স্ত্রী 'আচ্ছা' বলেছিলো কি না সে মনে করতে পারলো না। যদি 'আচ্ছা' বলে থাকে তবে সেটাই ছিলো তার শেষ কথা। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে সে তার স্ত্রীকে আর বাসায় পায়নি।
স্ত্রীর সাথে এমনিতে তার সম্পর্ক খারাপ ছিলো না। মূলত সে নিজেও মানুষ খারাপ নয়। চারবছরের সংসার জীবনে স্ত্রীর সাথে তপ্ত বাক্য বিনিময় পর্যন্ত হয়নি। সে ভেবে দেখলো, তার স্ত্রীকে নিয়ে সে সুখেই ছিলো। এমনিতে সে একটু আত্মকেন্দ্রিক চাপা স্বভাবের। নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগাগুলোও স্ত্রীর সাথে শেয়ার করেনি। সে মনে করতে পারলো না, স্ত্রীর সাথে সে কি বিষয় নিয়ে কথা বলতো। তাদের যৌন সম্পর্কেও দূরত্ব তৈরি হয় সেদিন থেকে যেদিন সে আবিষ্কার করলো তার স্ত্রী মাঝ রাত্রিতে কারো সাথে ফোনসেক্স করছে। খু্ব ঘেন্না ধরে গেলো তার। সে আর তার স্ত্রীর প্রতি সেক্স অনুভব করতো না।
ফোনসেক্স না, অন্যকারো সাথে সঙ্গম করলেও তার হয়তো এতোটা ঘেন্না লাগতো না যদি তার স্ত্রী তার সাথে প্রতারনা না করতো। তার মনে হলো এটা প্রতারনা। হ্যাঁ, সেটা রুমেলই হবে হয়তো। রুমেল তার চেয়েও সুদর্শন। বয়সেও বছর চারেকের ছোট। আচরণে চমৎকার। তার সাথে রুমেলের পরিচয় করিয়ে দেয় তারই এক বন্ধু। সিনেমা পাগল রুমেলকে একদিন সে বাসায় নিয়ে আসে। তার সিনেমার সংগ্রহ ছিলো খুব। রুমেলেরও ছিলো। তাই ঘন ঘন সিনেমা দেয়া নেয়ার ব্যাপারে বাসায় আসতে শুরু করে। ঘন ঘন আসাটা প্রতিদিন আসায় রূপ নিলো। সে বুঝতে পারলো, রুমেলের ভার্চুয়াল সিনেমার চেয়ে বাস্তবিক কোন সিনেমার প্রতি আকর্ষণ রয়েছে। এবং ব্যাপারটায় সে নিজেও মজা পাচ্ছিলো। দেখা যাক বিষয়টা কোন দিকে গড়ায়- ভেবেছিলো সে।
গেইমটা সে খেলতে চেয়েছিলো রুমেলের সাথে আর খেলার উপকরণ ছিলো তার স্ত্রী। নিজের উপর প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ছিলো তার। রুমেলকে সে বেশ কিছু সুযোগও দিলো, রুমেল যেন ভাবে খেলোয়ার হিসেবে সে দুর্বল ও বোকা। কিন্তু এক সকালে রুমেল একটা ভুল চাল দিলো আর সাথে সাথেই সে ধরে বসলো রুমেলকে। বোকাচোদা রুমেলও সাথে সাথে তার পায়ের কাছে পড়ে গেলো। অনুনয় করে বলে উঠলো, 'ভাই, আমি শুধু আপনার কাছেই আসি। আমার কোন দোষ নাই। আমার মনে কোন পাপ নাই।' শালা খেলা জমার আগেই হেরে বসতে চায়! ওখানেই খেলা শেষ করতে চায়নি। আরো খেলতে চেয়েছিলো সে। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে সেজে বসেছিলো বিরাট বোকা। যেন এসবের কিছুই বোঝে না। কিন্তু কিছুদিন পরই বুঝতে পেরেছিলো আসলে সে নিজেই হেরে যাচ্ছে বল যখন গোলপোস্টে ঢুকে যায় নিজের ইচ্ছায় খেলোয়ারের দক্ষতা সেখানে অসহায়
সেই রাতে যখন সে প্রথম আবিষ্কার করে তার স্ত্রী তাকে ফাঁকি দিয়ে ফোন সেক্স করছে, প্রথমে সে বিপন্ন বোধ করে। সে বুঝে উঠতে পারে না যে তার কি করা উচিত। আর এরপর থেকে সে তার স্ত্রীর প্রতি প্রচণ্ড ঘেন্না অনুভব করে। মনে হয় তার প্রতারক স্ত্রীর শরীর জুড়ে শুয়ো পোকা আর শুয়ো পোকা। কাপড় নাড়লেই টপাটপা পড়তে থাকবে। তাকে তার ছুঁতে ইচ্ছে করতো না মোটেও। তারপর ধীরে ধীরে দূরত্বের বসবাস এবং একদিন তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে রুমেলের কাছে চলে যায়। তার স্ত্রী চলে যাওয়ার পর সে বিভ্রান্ত হয়ে যায় এই ভেবে যে গেইমটিতে তার অবস্থান কোথায়, জয়ে না পরাজয়ে? কিন্তু আজ ১৬৮ টি কনডমের প্যাকেট হাতে সে যখন স্ত্রীকে অন্যের আশ্রিতা ভেবে ভোগের কল্পনায় তখন তার শরীর প্রচণ্ড জেগে ওঠে আর নিজেকে খুব জয়ী মনে হয়। সে ১৬৭ টি কনডম বাতাসে ফুলিয়ে ঘরে ঝুলিয়ে রাখে আর অন্যটি তার শরীরে।

মঙ্গলবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১২

ছায়াদর্জির গল্প



আমাদের শহরপাড়ায় এক দর্জি ছিলেন। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। ফর্সা মুখের তুথনিতে এক গোছা শাদা দাড়ি। মাথায় শাদা গোল টুপি। শাদা লুঙ্গি আর কখনো শাদা গেঞ্জি অথবা পাঞ্জাবি পড়ে তার কুঁড়ে ঘরটার একটা অংশ দোকানের মতো খুলে নানা রঙের কাপড় নিয়ে সারাদিন আপন মনে সেলাই করতে দেখতাম। কী সব পোশাক তিনি সেলাই করতেন তা জানতাম না। একদিন বাবার লুঙ্গি সেলাই করতে নিয়ে গিয়েছিলাম তার কাছে। আমার দিকে না তাকিয়েই এক মনে লাল রঙের একটা কাপড় সেলাই করতে করতে জানালেন, তিনি লুঙ্গি সেলাই করেন না। বন্ধুদের কাছে শুনেছি তারাও কারো শার্ট, কারো ভাবীর ব্লাউজ কিংবা বোনের কামিজ সেলাই করতে নিয়ে গিয়ে ফেরত এসেছে। আমরা ভাবতাম, তাহলে সারাদিন তিনি কী সেলাই করেন এতো!


এক দুপুর শেষে খাবার জন্য ঘরে ফেরার পথে দেখি দর্জি তার ভারী কালো ফ্রেমের চশমার ভেতর দিয়ে এক দৃষ্টে সূক্ষ্মভাবে দেখে কী যেন সেলাই করছেন। ভাবলাম, গিয়ে দেখি তার সেলাইকৃত পোশাকটা কী? কিন্তু নীল একটা কাপড় ছাড়া সেটা শার্ট না পাঞ্জবী অথবা অন্য কোন পোশাক কিনা কিছুই বুঝলাম না। তিনি অকস্মাৎ সেলাই থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন আমি কী চাই। আমার পকেট থেকে ঘামমোছা শাদা রুমালটা বের করে দিয়ে বললাম, বামহাতের একটা দস্তানা বানিয়ে দিতে। তিনি মৃদু হেসে বললেন, তিনি দস্তানা বানান না। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, তবে তিনি কি বানান? তিনি গম্ভীর হয়ে বিরক্ত সহকারে আমাকে আমার কাজে যেতে বললেন। আমি বেরিয়ে এসে আমার বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে বাম হাতে রুমালে ঘাড়ের ঘাম মুছতে মুছতে মনে মনে রাগ ঝারলাম, 'বালের দর্জি হইসে! বাল সেলাই করে!'


তারপর একদিন শীতের মৌসুমে যাত্রাবালার নাচ দেখে রাত করে ঘরে ফেরার সময় দেখি ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আমার ছায়া পড়ছে না। ভাবলাম কুয়াশা আলো খেয়ে ফেলায় হয়তো আমার ছায়া দেখছি না, যদিও সে রাতে কুয়াশা ছিলো না তেমন একটা। কিন্তু ঘরে এসে টাংস্টানের হলুদ বাতিতেও দেখলাম আমার ছায়া নেই। প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে ঘুমাতে গেলাম। পরদিন সূর্য উঠতেই দৌড়ে মাঠে দাঁড়ালাম। নাহ্, কোন ছায়া নেই। কিছুতেই স্মরণ করতে পারলাম না শেষবার কখন ছায়াটাকে আমি দেখেছিলাম।


বিষয়টা রটে গেলো। আমি প্রচণ্ড বিব্রত। বাবা-মাও দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হলেন।পরিচিতরা দেখা হওয়া মাত্রই আমার ছায়া সম্পর্কে খোঁজ-খবর জিজ্ঞেস করতো। যেন আমার চেয়ে আমার ছায়ার গুরুত্ব বেশি। যদিও ছায়া থাকা আর না থাকা তেমন গুরুতর কোন বিষয় না। কিন্তু আলোতে গেলেই ছায়াহীনতা আমার বুকের মাঝে শূন্যতার সৃষ্টি করতো। খুব মন খারাপ হতো। লেজকাটা শেয়ালটার মতো বিব্রত থাকতাম সবসময়। বুঝতে পারি আমাকে দেখে লোকজন গোপনে হাসাহাসি করে। আর ব্যতিক্রম যে এই সমাজ সহজে মেনে নিতে পারে না সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।


ছায়া হারানোর কষ্ট আর লোকজনের তীর্যক মন্তব্য ও অস্বাভাবিক আচরণ আমাকে প্রচণ্ড আহত করায় মন খারাপ হতো খুব। কেউ আমাকে বোঝার চেষ্টা করতো বলে মনে হতো না আমার কাছে। তাই প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি আমাদের নদীটার উপর নির্জন রেলব্রীজটার পাশে চুপচাপ বসে থাকতাম। লক্ষ্য করলাম রেলব্রীজটার অদূরে তিনতলা একটা বাড়ির ছাদ থেকে একটা কিশোরী আমাকে চুপচাপ দেখে। আমার মনে হলো আর আর মানুষের মতো সেও আমার ছায়াহীনতা আমাকে জোকার কিংবা অদ্ভুত কোন এক প্রাণীর মতোই ধরে নিয়ে আগ্রহ থেকেই চুপচাপ আমাকে দেখার চেষ্টা করে। এক বিকেলে হাঁটতে আসার ছলে কিশোরী আমার পাশে এসে দাঁড়ায় এবং জিজ্ঞেস করে কেন শুধু শুধু আমি মন খারাপ করছি। আর এও বলে, ছায়া এমন কোন গুরুতর বিষয় নয়। আমি তাকে এই বলি যে, সে যদি তার ছায়া হারাতো তাহলে সে বুঝতে পারতো। তখন সে জানায় তার এক মামাতো ভাই যে কিনা সালমান খানের মতো দেখতে ছিলো, সে ছায়া হারিয়ে ছায়ার কষ্টে আত্মহত্যা করে। তাই সে ভয় পাচ্ছে আমিও এমন কোন কিছু করে বসি কিনা। আমি চুপচাপ ঘরে ফিরি সে দিন।


বন্ধুবান্ধব আমাকে নিয়ে বিব্রত, বিব্রত আত্মীয় স্বজনও। কোন কোন আত্মীয় স্বজন বাসায় এসে বাবা মাকে কথা শুনিয়ে যায়। আমার ছায়া আমাকে ছেড়ে যাওয়ায় তারা সমাজে মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারছে না। বাবা-মারও সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত হলে আমাকে ছায়া ছেড়ে যাওয়ার কথা বলে তিরস্কার করে। আমার খুব মন খারাপ হয়। আমিও ভাবি এই উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে আমাকে আত্মহত্যার পথই বেছে নিতে হবে। এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই।


সকালে এসে দাঁড়িয়েছি রেল ব্রীজটার কাছে এই ভেবে যে প্রথম যে ট্রেনটা আসবে সেটার নীচেই কাটা পড়ে মারা যাবো। কিছুক্ষণ পর কিশোরীটা এসে হাজির। সেদিনের পর থেকে সে প্রায়ই এসে আমার সাথে ছায়া এবং তার মামাতো ভাই সম্পর্কে কথা বলতো। তাকে আমি জানালাম আজই তার মামাতো ভাইএর মতো আমিও ছায়াহীন দেহ ত্যাগ করবো। সে বিষণ্ণ হলো। আমাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলো যে ছায়াহীনতা কোন বিষয় নয়। দূরে কোন শহরে গিয়ে একা একা বেঁচে থাকাও সম্ভব, সে একথাও বললো। শেষে সে তার নিজের ছায়াটাই আমাকে দিয়ে দিতে চাইলো। আমি জানতে চাইলাম, সে ছায়াহীন কি করে বাঁচবে এবং তার কি ছায়ার জন্য শূন্যতা অনুভূত হবে না আর তার বাবা-মা, আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধব তাকে নিয়ে বিব্রত বোধ করলে সে তা কিভাবে মোকাবেলা করবে। সে দৃঢ় কণ্ঠে জানালো এগুলো তার কাছে কোন বিষয় না। আমি তাকে আমার শঙ্কার কথা জানিয়ে দিলাম, ছায়ার অভাবে হয়তো তার বিয়েও হবে না কোনদিন! আর তাই আমি তার এতো বড়ো ক্ষতি করে তার ছায়া নিতে অস্বীকৃতি জানালাম। শেষে সে আমাকে পাঁচ বছরের জন্য ছায়াটা ধার দেয়ার কথা বললো। সে জানালো, পাঁচ বছরের আগে তার বিয়ের সম্ভাবনা নেই। তার যখন বিয়ে হবে তখন সে তার ছায়াটা আমার কাছ থেকে ফেরত নিয়ে যাবে। এ কথায় ছায়াহীন ক্লান্ত নিস্তেজ এবং বিপর্যস্ত আমি তার সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম। কিন্তু সমস্যা হলো তার দেয়া ছায়াটা আমার সাথে আসে না। সে চলার সাথে সাথে ছায়া তার সাথে চলে যায়। কিছুতেই ছায়াটাকে আমার সাথে চলাতে পারছিলাম না। সে তখন পরামর্শ দিলো, তার ছায়াটা আমার পায়ের সাথে সেলাই করে নিলে হয়তো ছায়াটা আমার সাথেই থাকবে। তবে ছায়া সেলাই করার মতো এমন সূক্ষ্ম সেলাই জানা দর্জি পাওয়া কঠিন বলেও সে জানালো। আমার তখন আমাদের পাড়ার সেই দর্জিটার কথা স্মরণ হয়। আমি কিশোরী আর তার ছায়াকে নিয়ে দর্জির কাছে যাই। দর্জি তখন কি যেন একটা সেলাই করা নিয়ে ব্যস্ত। তাঁকে গিয়ে অনুরোধ করে বললাম তিনি যেন আমার সাথে কিশোরীর ছায়াটা সেলাই করে দেন। তিনি কিছু বললেন না। আমি ভাবলাম এবারও হয়তো তিনি সেলাই করতে চাইবেন না এবং আমাদের চলে যেতে বলবেন। কিন্তু তিনি তার হাতের কাজটা রেখে উঠে গিয়ে তাকে রাখা একটা বাকশো থেকে বের করে নিয়ে আসলেন সোনামুখি সুই, চিকন সুতো আর এক টুকরা টকটকে লাল কাপড়। তারপর ভারী চশমাটা চোখে লাগিয়ে খুব নিপুন ভাবে কিশোরীর ছায়াটাকে আমার পায়ের সাথে লাল কাপড়ের জোড়া দিয়ে সেলাই করে দিলেন।

শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১১

দিন যাপনের খসড়া খাতা ১

০১.০১.২০১২

ভাবছি তুমি আমাকে ভালোবাসো কেন? বুড়িয়ে গেছিতো। সাতাশ পাড়ি দিচ্ছি। সামনের সেপ্টেম্বরে আটাশ হয়ে যাবে। অথচ জীবন পচা ডিমের গন্ধ ছড়াচ্ছে।

মঙ্গলবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১১

ভেতরে নীল রঙের ষড়যন্ত্র

একটা নির্বোধ পোকা কেটে গেছে আমার প্রিয় শীতের সোয়েটার
এটা পরে আমি আর বাইরে যেতে পারি না, হুহু করে শীত ঢুকে যায়

তবু পোকাটার জন্য আমার মায়া হয়, নাম না জানা দাঁতাল পোকা

শুক্রবার, ১১ নভেম্বর, ২০১১

এক বাক্যের গল্প

গল্প:০১>
একদিন নদী থেকে আঁজলা ভরে জল নেয়ার সময় আঙুলের ফাঁক দিয়ে সব জল পড়ে যেতে দেখে ঠাকুরদা শঙ্কিত হয়ে বলেছিলেন, 'তোর আঙুলের ফাঁক দিয়েতো তুই তোর ভবিষ্যত ফেলে দিবিরে!' তারও বহুদিন পর মনে হলো সত্যি সত্যিই বুঝি আঙুলের ফাঁক দিয়ে আমি আমার সব কিছু ফেলে এসেছি
গল্প:০২>
সারাজীবন নয়টা-ছয়টা অফিস করে আধপেটা খেয়ে একটাকা দুইটাকা করে জমিয়ে এবং শেষ বয়সে পেনসনের টাকাটা পেয়ে তিনি যখন বাড়ি করছিলেন তখন বাড়ির ডিজাইন, ইঞ্জিনিয়ার, শ্রমিক, ইটকাঠপাথর, এলাকার ছেলেপেলে ইত্যাদির ধকল সইতে না পেরে বুক চেপে মরে গেলে মসজিদের মাইক থেকে তার মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা হলে ঘোষকের সাথে সাথে আমরাও ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্নাইলাহে রাজিওন বললাম
গল্প:০৩>
কালো মেয়েটি ফেয়ার এন্ড লাভলি মেখে মেখেও ছেলেটির উদাসীনতায় নিজেকে ব্যর্থ ভেবে 420 আব্দুল করিমের সাথে চলে গেলে, উদাসীন ছেলেটি মেয়েটির কালো অথচ মিষ্টি মুখশ্রীর কথা স্মরণ করে ভাবে- উড্ডীনকালে আলোর বিপরীতে সকল পাখিই কালো দেখায় আর মানুষ মূলত কথিত স্রষ্টার ন্যায় প্রশংসা পছন্দ করে
গল্প:০৪>
সামান্য সরকারী চাকুরে বাবার শুধু বেতনের টাকায় শহরের সংসার খরচ চালিয়ে গ্রামের দাদা-দাদীকেও কিছু টাকা পাঠিয়ে মাস শেষে যখন শূন্য হাত তখন অবিবেচক আমার একটা ফুটবলের আবদার তাঁকে বিব্রত করে এবং তিনি তা কিনে দিতে অস্বীকৃতি জানালে সারা বিকাল কেঁদে টেদে হতাশার ঘুম শেষে জেগে পাশে একটা শাদাকালো ফুটবল আবিষ্কার করে আনন্দে আটখানা হয়ে দেখি সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে
গল্প:০৫>
বালকটি মসজিদের ইমাম হুজুরের কাছে কুরআন পাঠ শিখতে গেলে ইমাম হুযুর তার ছোট ভাইয়ের কথা স্মরণ করে কাঁদে আর কুরআন ছুঁয়ে ছেলেটিকে শপথ করায় যে হুযুর যা বলবে বা করবে তা অন্য কাউকে কোনদিন কোনসময় কোনভাবেই বলা যাবে না এবং ছেলেটি সরল মনেই এই শপথ করে তারপর হুযুর তাকে আড়ালে অন্ধকারে ডেকে নিয়ে যায় এবং অন্ধকারে রক্তাক্ত হয়ে ছেলেটি নরপশুর কুৎসিত রূপ যখন আবিষ্কার করে তখন সেই কথিত পবিত্র গ্রন্থের কোন পৃষ্ঠায় সেই রক্তের দাগ লেগে থাকে কিনা জানতে চায়লে পীরে আওলিয়া হুজুরে কেরামত দরবারে চিশতী মাওলানা আবদুল বাসেদ ইসলামপুরী প্রথমে বিভ্রান্ত হন অতঃপর গলা খাকড়ি দিয়ে “সব আল্লাহু রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছা, তিনিই পবিত্র রাখেন সকল অপবিত্রতা থেকে” বললে মাজহারুল ইসলাম মুন্না মনে মনে বলে ওঠে ‘হারামজাদা’
গল্প:০৬>
বাইগনবাড়ি স্টেশনে মাঝরাতে ট্রেন থেকে নেমে বাড়ি ফেরার জন্য কোন রিকশা বা ভ্যান না পেয়ে অমাবশ্যার অন্ধকারে একা একা হেঁটেই রওয়ানা হলে একটি কুকুর তার সঙ্গী হয় কিন্তু মনতলা বাজার পেরুতেই কুকুরটি নিরুদ্দেশ হলে তার সদ্যমৃতা স্ত্রীর কথা স্মরণ হয় এবং বাকীটা পথ একাই চলতে হবে ভেবে বুকের ভেতর একটা শূন্যতা অনুভব করতে থাকেন
গল্প:০৭>
ঢাকা ফেরৎ শেফালি তার গর্ভের সন্তানের জনক 'সাইদুলমিয়া' দাবী করলে সাইদুলমিয়া তা অস্বীকার করে কিন্তু সমাজের গণ্যমান্য জঘন্য ব্যক্তিবর্গ সালিশে তাকে লুচ্চা, লম্পট অভিহিত করে কাজী ডেকে শেফালির সাথে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়ার পর বাসর রাতেই সাইদুলমিয়া বাড়ির পাশের কামরাঙা গাছের ডালে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে কারণ সে কাউকেই বুঝাতে পারেনি কেবল চুম্বনে গর্ভসঞ্চার হয় না
গল্প:০৮>
জ্ঞানের ঘাটে রাতের অন্ধকারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে নীরবে করিমন বিবি কাঁদতে থাকার সময় হঠাৎ শহর আলি তার পাশে এসে দাঁড়ালে শহর আলির শরীরের ঘ্রাণ তাকে মোহিত করে এবং শহর আলি তাকে বুকে টেনে নিলে সালমার লাল জুতা আর রঙিন শাড়ির মতো তারও লাল জুতা আর রঙিন শাড়ি না থাকার ব্যথা ভুলে যায়
 গল্প:০৯>
উঠোনে ধরানো আগুন থেকে পোড়া মিষ্টি আলুর খোসা ছাড়িয়ে একটুকরো ভেঙ্গে মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে ভাবে- 'গত বছরের তুলনায় এবার শীত কি বেশি পড়লো, নাকি 'সে' চলে যাওয়ায় শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে!' যদিও প্রতিটি শীত চলে গেলে আমরা পরিযায়ী পাখির কথা ভুলে যাই
গল্প:১০>
সে তার অবসন্ন দেহটি ছড়িয়ে দেয় মেঠোঘরের শীতল বিছানায় তখন নৃত্যরত জোছনা চালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে জন্ম দেয় শাদা ও নরোম দ্বিতীয় মানুষটির তারপর সে আঙুলে জড়ায় স্পর্শ আর কোথাও একতালে গাঢ়ো অথচ ধীর লয়ে বেজে ওঠে স্প্যানিশ গিটার
গল্প:১১>
স্কুলে দেরী করে আসায় প্রথম বেঞ্চে স্থান না পেয়ে প্রতিদিন শেষের বেঞ্চে বসা আমার পাশে প্রথম সে বসে এবং স্কুল শেষে আমাকে বন্ধু ডেকে তার বাসায় নিয়ে গিয়ে তার অনেক খেলনা দিয়ে দু'জনে দীর্ঘ সময় খেলি কিন্তু ফেরার সময় তার একটা খেলনা পাওয়া যাচ্ছে না বলে আমার ব্যাগ সার্চ করে সেখানে কোন খেলনা না পেয়ে বলে – ‘সরি , দোস্ত’ আর আমি কোনদিন কাউকে বন্ধু ভাবতে পারি না
গল্প:১২>
দূরে কোথাও নিশিপাখি কর্কশ কণ্ঠে ডেকে ওঠলে ভয়ে সে আমার ঘনিষ্ট হয়ে শক্ত করে হাত ধরে থেকে ভয় দূর করে অথচ আর একটু পথ হাঁটলেই নির্জন ডুবাটার পাশে আমি তার গলা চেপে ধরবো
গল্প:১৩>
সুপর্ণার বাম স্তনে একটা কালো তিল আছে এই কথা ক্যাম্পাসে রতন ছড়িয়ে দিলে সে কথা সোহানের কানেও যায় আর সোহান যখন সুপর্ণাকে অবিশ্বাসের চাবুকে আঘাত করে তখন প্রচণ্ড আহত সুপর্ণা ভাবে কোন কুক্ষণে সে তার রুমমেট আবিদাকে জানিয়েছিলো তার একটি গোপন তিলের কথা
গল্প:১৪>
ছোট্ট মেয়েটির গাল টিপে আদর করে "এমন কিউট একটা বেবিকে রেখে তার মা কাজে যায় কী করে, হুমমম? আপনাদের তো অভাব নেই, ভাবীর চাকরি করতে হয় কেন বুঝি না" এই কথা বলে সে মেয়েটির বাবার মন ও মনোযোগ আকর্ষণ করে আর অচিরেই আমরা একটা খেলা জমে উঠতে দেখবো কেননা শী ইজ অ্যা গেইমার
গল্প: ১৫>
এ এক আজব ব্যাপার ঘটে যায় দুপুরে যখন সে একচোখাবৃদ্ধের দেয়া হলুদ মাল্টা ফল কেটে স্বামীর পরিবর্তে গোপন বন্ধুকে দেয় তখন সে দেখে মাল্টা থেকে লাল ডালিমের রস বেরোয় আর তার নিজের উরুসন্ধি বেয়ে নেমে আসে চাক চাক রক্ত এবং স্বামীটাও হয়তো তখন পান করছিলো লাল ডালিমের রস কিংবা বেকুবটা তখন হলুদ আলোর বদ্ধঘরে বসে হিসাব কষছিলো অথবা মাইলের পর মাইল সূর্যতাপে দগ্ধ হয়ে শূন্য মাঠে ঘেমে ঘেমে হাঁটছিলো
গল্প: ১৬>
বৃদ্ধ রিকশাওয়ালাটিকে জোয়ান রিকশাওয়ালাটি দ্রুতগতিতে অতিক্রম করে গেলে বৃদ্ধটি “অই পইড়া গেছে!” মিথ্যা বলে, ফলে তরুণ রিকশাওয়ালাটি গতি কমিয়ে থামে আর বৃদ্ধটি তাকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে গিয়ে মিট মিট হাসে এবং অনতিবিলম্বে তরুণ রিকশাওয়ালাটি পুনরায় দ্রুতগতিতে বৃদ্ধকে অতিক্রম করতে চাইলে প্রথমে সাইড দেয় কিন্তু পরক্ষণেই রাস্তার মাঝখানে চলে আসে তখন তরুণ রিকশাওয়ালাটি রিকশার গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে র্দুঘটনার শিকার হলে বৃদ্ধটি চোয়াল শক্ত করে চাবিয়ে চাবিয়ে বলে, ‘শালার জৈবন’
গল্প: ১৭>
এ্যাকুরিয়ামের মাছগুলো কথা বলা শিখে গেলে আমরা একটি একটি করে তাদের সবকটিকে মেরে ফেলে নিঃশ্চিন্ত হলাম
গল্প: ১৮>
চতুর্থবারের মতো আত্মহননে ব্যর্থ হলে সে আমার পিঠে হাত রেখে গাঢ়ো কণ্ঠে বলে, 'চুপচাপ বেঁচে থাকাই আত্মহত্যার সহজ উপায়' তখন আকাশে একটা চিল সূর্যের চারপাশে উড়ছিলো কিনা মনে নেই
গল্প: ১৯>
খরায় সকল জলাশয় শুকিয়ে সব মাছ মরে গেলে গভীর জলাশয়টির শেষ জলটুকুতে একটি পুঁটি মাছ তখন জীবিত ছিলো, তার পাশেই বাঁশের খুঁটিটিতে ক্ষুধার্ত মলিন কাতর মাছরাঙা বন্ধুটিকে বসে থাকতে দেখে- "বন্ধু, আজ দুপুর পর্যন্ত রোদ গড়ালে এই জলাশয়ের শেষ জলবিন্দুটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আর তখন আমার মৃত্যু নিশ্চিত; এর চেয়ে তুমি আমাকে খেয়ে ফেল, তুমি অন্তত একদিন বেশি বাঁচবে" এই কথা বলে এবং যখন দুপুর গড়িয়ে গেল আর মাছরাঙা চোখে জল নিয়ে প্রিয় বন্ধু পুঁটি মাছটিকে খেতে শুরু করলো তখন পুঁটি মাছটি মরে যেতে যেতে তার নিজের রক্তে মাছরাঙার বুকটি লাল করে দিয়ে গেল
গল্প: ২০>
শঙ্খমিত্রার ম্যালা জল শুকিয়ে গেলো এবং অনেক নৌকার পালও বদল হলো এই ত্রিশ বছরে তবুও ফুলবানুর খোঁজ আর না পেয়ে সকলেই তাকে প্রায় ভুলে যায় আর আক্কেল মিয়াও তার শালিকা পরীবানুকে বিয়ে করে ত্রিশ বছরের সংসার যাপন করে কিন্তু মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে আক্কেল মিয়া যখন অবচেতন মনে ডুকরে কেঁদে বলে, ‘ও ফুলবানু, তুই আমারে ক্ষমা করিস ফুলবানু’ তখন পরীবানু ভাবে তার বোনের প্রতি আক্কেল মিয়ার প্রেম বুঝি চাগার দিয়ে ওঠে কিন্তু কারো কারো মনে এই প্রশ্ন উঁকি দিয়ে ওঠে যে, ক্যান আক্কেল মিয়া মরার সময় ফুলবানুর কাছে ক্ষমা চায়?
শেষ গল্প>
কিশোরী মেয়েটি তার টিউটরের প্রেমে পড়ে গেলে মা তা বুঝতে পারে এবং এক সন্ধ্যায় মা টিউটরের হাত ধরে বসে থাকে তারপর মেয়েটিকে বলে, তোমার টিউটরের মতো অসভ্য আমি দেখিনি, সে আমার হাত ধরতে চায়, আমি ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলিনি, শুধু বেতন দিয়ে বলেছি আর যেন এ বাসায় না আসে

বৃহস্পতিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১১

চোখ মরে গেছে, মিথ্যা আলোয় দৃশ্য রচনা করে মন


আয়নায় মুখ দেখি। এতবার দেখা মুখ তবু অচেনা ঠেকে। এই যে জড়িয়ে যাচ্ছি অচেনা আমিতে, যখন বিস্মৃতির জঙ্গল থেকে জেগে উঠবে বিষধর কেউটে, তখন তুমি কি করবে? শুধাই আমায়। আমি একচিলতে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থেকে বার বার ঘুরে ঘুরে আমাকে দেখি। চোখের পাতায় আঁকি মৃত্যুরঙের ফুল।

নিজের ভেতর অবলুপ্ত শহর। আমি তার মেয়রকে গোপনে চিঠি লিখি।

সে বলে এই সত্যের আড়াল থেকে তুমি বেরুতে পারবে না। দেখো এই বিরান ভূমি। আমার ভেতর লাল হয়ে জমে থাকা তৃষ্ণা। তুমি আমাকে স্পর্শ কর একবার মৃত্যুর জন্য। এই আড়ালে তোমার মগ্নতা ভেঙ্গে ফেলো ঋষি। দেখো আমি উতলা পুঁই গাছ।

একটা বন্ধ ঘরে আমি তখন জেগে উঠি। রোদ।

শৈশবে আমাদের এখানে এক মহিলা ভিক্ষুক আসতেন ভিক্ষা নিতে। তার একটা চোখ পাথরের ছিলো। সে এসেই তার পাথরের চোখ খুলে আমাদের তাক লাগিয়ে দিত। তারপর আমরা আবার তার চোখ খুলে ফেলার খেলা দেখতে চাইতাম। কিন্তু সে তখন তার অনেক ক্ষতি হবে বলতো এবং ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে সে পুনরায় চোখ খুলে দেখাতে রাজী হওয়ার কথাও বলতো, আমরা তখন খেলা দেখতে নারাজ হতাম। একদিন খুব অভাবে পড়ায় সম্ভবত সে দশ টাকার বিনিময়ে তার চোখ খুলে দেখানোয় রাজী হয় কোন রকম ক্ষতিপূরণ ছাড়াই। একটা স্বচ্ছ গ্লাসে চাপকলের শীতল জলে তার পাথরের চোখটি খুলে রাখে সে, আমরা বিস্মিত হয়ে সেই চোখটিকে গ্লাসের জলে ভাসতে দেখি। বড় কুৎসিত লাগে।

বহুদিন পর নিজেকে জলে ভাসা কুৎসিত চোখ বলে মনে হচ্ছে। আমার পাপবিদ্ধ মন।

মনবাড়িতে একা একা ট্রেনকাটা রোদে দাঁড়িয়েছিলাম। অদূরেই এক জাদুকর তার ঝোলার ভেতর থেকে বের করে আনলো অনেকগুলো মরা চোখ। ঘোর লাগা চোখে আমরা সেই চোখ দেখি। দেখি রুমালের আলোড়নে মাটি হয় ধন। ছুঃমন্তরে শূণ্য থেকে ধরে ধরে আনে নতুন টাকার নোট। তবুও জাদু শেষে সে বিক্রি করে কৃমির ওষুধ।

জানি তার চোখ মরে গেছে। তবুও মিথ্যা আলোয় দৃশ্য রচনা করে মন।

সত্য এই, মানুষেরই রয়েছে মানুষের রূপ। কেউ একটা ভুল পথে অন্ধকার, আমার চোখ জুড়ে রোদ চশমা। অন্ধপাখির গান। মজে আছি ডুবোপ্রেমে, আঙুলের স্পর্শে সোনা হয় কাঠ। স্মৃতি মুছে চাষ করি শিলালিপি। মেঠোঘরে পাঠ করি দেয়াল লিখন। রাত্রি এসে ফিরে যায় ঘুম শহরের পথে একা একা। আজ কোন ট্রেন আসেনি। হেঁটে হেঁটে ঘরে ফিরি তার কাজলটানারাতে।

তরল সকল প্রতিবন্ধকতা পাশ কাটিয়ে গতিশীল, বুঝি প্রেম